পলাশ প্রতিনিধি: ব্রহ্মপুত্র নদের তীরেই গড়ে উঠেছিল নরসিংদীর বাবুরহাট। কালের পরিক্রমায় বাবুরহাট এখন দেশের সর্ববৃহৎ পাইকারি কাপড়ের বাজার। হাট ঘিরেই নরসিংদীতে হয়েছে শিল্প-বিপ্লব। কিন্তু জলবাযু পরিবর্তন ও মানুষ্য সৃষ্ট দূষণে পুরোপুরি শুকিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ মরণফাঁদে পরিনত হয়েছিল। একই হাল জেলার অন্য দুটি নদী আড়িয়াল খাঁ ও হাঁড়িদোয়ার। এ অবস্থায় নদীগুলোকে বাঁচাতে খননের উদ্যোগ নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
৫শত ২৮ কোটি ১৮ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ব্রহ্মপুত্র, আড়িয়াল খাঁ ও হাঁড়িদোয়া নদী পুঃনখননের কাজ শুরু হয়েছে। গেল বছর ২৮ এপ্রিল নদীর গুলোর পুঃনখননের কাজ শুরু হয়। আগামী বছরের মধ্যে এর পুঃনখননের কাজ শেষ হবে বলে জানায় নরসিংদী পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড এবং এর তত্ত্বাবধানে রয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রকল্পটির নদী পুনঃখনন কাজ ২৩১.৮০ কিলোমিটার, ঢেউয়ের আঘাত হতে নদীর তীর রক্ষার কাজ ২২.২০৪ কিলোমিটার, নদীর তীর প্রতিরক্ষামূলক কাজ ১.১৫০ কিলোমিটার, ব্রিজ শক্তিশালী করণ কাজ ৮৫টি ব্রিজ।
এছাড়াও নদী সমূহের খননকৃত মাটির দ্বারা নদীর দুই পাড়ের বিদ্যমান রাস্তা, খেলার মাঠ, জনসাধারণের ব্যবহারযোগ্য ভূমি, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, গীর্জার ভিটা/ আঙ্গিনা ভরাট এবং জনসাধারণের মালিকাধীন অপেক্ষাকৃত নিচু কৃষি ভূমি অথবা পতিত ভূমি চাষাবাদযোগ্য করার লক্ষ্যে উঁচুকরণ কাজে ব্যবহার করা হবে। জানা যায়, ২০১৫ সালে প্রথম পর্যায়ে আড়িয়াল খাঁ নদীর একাংশের খননকাজ শুরু হলেও বর্ষা ও বৃষ্টির কারনে বন্ধ হয়ে যায়। এবার পুরোদমে ব্রহ্মপুত্র, আড়িয়াল খাঁ ও হাঁড়িদোয়া নদী পুঃনখননের কাজ শুরু হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদ নরসিংদীর পলাশ উপজেলার চরনগরী নামক স্থানের হাঁড়িদোয়া নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে বাবুরহাট ও মাধবদী শিল্পাঞ্চলের ওপর দিয়ে নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দের শীতলক্ষ্যা নদীতে মিলিত হয়েছে। আড়িয়াল খাঁ নদী নরসিংদীর বেলাবর ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে উৎপত্তি হয়ে শিবপুর ও সদর উপজেলার ওপর দিয়ে রায়পুরার নলবাটায় মেঘনা নদীতে মিলিত হয়েছে।
হাঁড়িদোয়া নদী পলাশ উপজেলার চরসিন্ধুর আলীনগর বাজারের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে শিবপুরের ওপর দিয়ে নরসিংদী পুরাতন থানা ঘাট হয়ে মেঘনা নদীতে মিলিত হয়েছে। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদের দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৫ কিলোমিটার, আড়িয়াল খাঁ নদী ৩১ দশমিক ২০ কিলোমিটার ও হাঁড়িদোয়া নদী প্রায় ১৯ কিলোমিটার। নদীর তীরবর্তী সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একসময় নদীগুলো দিয়ে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে লঞ্চ ও ইঞ্জিনের নৌকা চলত। এখন নৌকাও চলতে পারে না। কোথাও একদম পানি নেই। কোথাও হাঁটুপানি থাকলেও কচুরিপানায় ঢেকে আছে। তবে এদের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র ও হাঁড়িদোয়া নদীর পানি শিল্প-কারখানার বর্জ্যে বিষাক্ত। পলাশের জিনারদী ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র তীরের বাসিন্দা কবির হোসেন জানান, এই নদী দিয়ে একসময় পাল তুলে নৌকা যেত। নদীর পানি দিয়ে আমরা খেতে ফসল করতাম। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় মানুষ দখল কইরা ও বাঁধ দিয়া রাস্তা বানাইয়া নদীটারে মাইরা ফালাইছে। সরকার এই নদী খনন করে আমাদের অনেক উপকার করেছে। শিবপুর সাধারচর গ্রামের কৃষক হোসেন আলী জানান, দীর্ঘ বছর ধরে নদীতে পানি না থাকায় এটি শুকিয়ে মরে গিয়েছিল। এখন এটি খনন করায় নদীর হারানো প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। নদীর পাশ জুড়ে ফসলী জমিতে চাষাবাদের জন্য সেচ ব্যবস্থার আর কোন অসুবিধা হবে না।
পানি উন্নয়ন বোড নরসিংদীর নির্বাহী প্রকৌশলী বিজয় ইন্দ্র শংকর চক্রবর্তী জানায়, হাইড্রোজিক্যাল এবং মরফলজিক্যাল কাঠামো পরিবর্তন এবং অব্যাহত পলি পড়ার কারণে নদীগুলোর ধারণক্ষমতা কমে গেছে। এর ফলে শুষ্ক মৌসুমে নাব্যতা কমে নদীর প্রবাহ থাকে না। এ অবস্থায় নদীগুলো বাঁচাতে সরকারের কাছে বিভিন্ন মহল থেকে খননের দাবি জানায়। এরপর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জের ড্রেজার দপ্তর যৌথভাবে নদীগুলোর জরিপ করা হয়। নদীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতি ব্রহ্মপুত্র নদের। নদ দখল করে দুই তীরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য শিল্প-কারখানা। তিনি আরো বলেন, নদীগুলো ড্রেজিং করে গভীরতা বাড়ালে পানির প্রবাহ বাড়বে। এর ফলে বেড়ে যাবে মাছের উৎপাদন। ফিরে আসবে নৌ চলাচলের স্বাভাবিক অবস্থা। কৃষিজমিতে সেচ সুবিধাসহ এলাকার জনসাধারণ দৈনন্দিন কাজে পানির চাহিদা পূরণ করাও সম্ভব হবে।
এখানে কমেন্ট করুন: