স্টাফ রিপোটার
সংবাদ প্রকাশের কারণে সম্পাদক, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাকে স্বাধীন সাংবাদিকতার উপর কুঠারাঘাত বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এএম আমিন উদ্দিন। তিনি বলেছেন, সত্য প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করতেই, মানুষের জানার অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করতেই এ ধরনের মামলা করা হয়। প্রকারান্তরে এটি দুর্নীতিকে আরও উৎসাহিত করবে।ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম নিয়ে এক সংবাদের জেরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীর বিরুদ্ধে ঠাকুরগাঁওয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার প্রতিক্রিয়ায় একথা বলেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি।ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা মোমিনুল ইসলাম ভাসানী এই মামলাটি করেন।
তিনি জাগো নিউজের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকারকেও আসামি করেছেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এএম আমিন উদ্দিনসুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এএম আমিন উদ্দিনতৌফিক ইমরোজ খালিদীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার প্রতিক্রিয়ায় সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের নেতা আমিন উদ্দিন বলেন, “সংবাদ মাধ্যমে দুর্নীতির খবর প্রকাশ করার পর যদি সাংবাদিক-সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়, তাহলে কোনো মানুষই কোনো খবর প্রকাশ করবে না।আমি মনে করি এ ধরনের পদক্ষেপ স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের উপর যেমন কুঠারাঘাত, তেমনিভাবে মানুষের সঠিক সংবাদ পাওয়ার অধিকার হরণের নামান্তর। এছাড়াও গত ২১ এপ্রিল ২০২০: নরসিংদীতে নিউজ সময়.কমের সম্পাদক বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল নিউজ টোয়েন্টিফোরের সাংবাদিক হৃদয় খান ও নিউজ সময়.কমের প্রকাশক গ্লোবাল টেলিভিশনের ও নরসিংদী জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম(মতি)র বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা দায়ের করা হয়েছে।
২১ এপ্রিল নরসিংদী শহরের সাটিরপাড়া মহল্লার বাসিন্দা আব্দুল বাছেদের ছেলে নুরে আলম নামের একজন বাদি হয়ে নরসিংদী সদর মডেল থানায় মামলাটি দায়ের করেন। দুই সাংবাদিক সম্পর্কে পিতাপুত্র। এ ঘটনায় বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম-বিএমএসএফ’র কেন্দ্রীয় সভাপতি শহীদুল ইসলাম পাইলট ও সাধারণ সম্পাদক আহমেদ আবু জাফর সহ স্থানীয় সাংবাদিক সমাজ সহ সকল শ্রেণীপেশার মানুষ তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সেই সাথে অনতিবিলম্বে এ মামলাটি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন তারা।এ ব্যাপারে হৃদয় খান ও শফিকুল ইসলাম(মতি) বলেন, মামলার বাদী তার অভিযোগে উল্লেখ্য করেছেন আমরা আমাদের ব্যক্তিগত ফেইসবুক আইডি থেকে স্থানীয় সাংসদ নজরুল ইসলাম হিরুএবং এস এম কাইয়ুম এর নাম ব্যবহার করে মানহানীকর স্ট্যাটাস প্রদান করি।
কিন্তুু আমরা আমাদের ব্যক্তিগত ফেইসবুক আইডি থেকে এরকম কোন স্ট্যাটাস দেইনি। সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে আমাদের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। গত ১৮ এপ্রিল নরসিংদী চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আলী হোসেন শিশির চেম্বার ভবনের সম্মেলন কক্ষে পরিচালকদের উপস্থিতিতে প্রতিবাদ সভায় একটি বক্তব্য দেন। সেই বক্তব্যের ভিডিওটি বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। ভিডিওটিতে চেম্বারের সভাপতি অভিযোগ করেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলার মুহূর্তে সময় স্বল্পতার জন্য সদরের মাননীয় এমপি’র নাম বলতে না পারায় তিনি আমার প্রতি ক্ষুব্ধ হন। এঘটনায় তিনি জেলা আওয়ামী লীগের বহিস্কৃত নেতা এসএম কাইয়ুমের সমন্বয়ে তাঁরই আশীর্বাদপুষ্ট কয়েকজন নামধারী শ্রমিক নেতাদের মাধ্যমে আমার বিরুদ্ধে অশ্লীল স্লোগানে বিক্ষোভ মিছিল করে। এ মিছিলটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও ঈর্ষান্বিত এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান নরসিংদী চেম্বার। কনফারেন্স ও চেম্বারের প্রতিবাদের বক্তব্যের ভিত্তিতে নিউজ সময়.কম, নরসিংদী প্রতিদিন.কম, ব্রেকিং নিউজ.কম.বিডি, সময়ের কণ্ঠস্বর, নরসিংদীর অপরাধ কণ্ঠ, নরসিংদীর ই-পত্রিকা সহ অন্যান্য গণমাধ্যমে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেখানে সাংবাদিক হৃদয় খান ও শফিকুল ইসলামের নিজস্ব কোন বক্তব্য নেই।
তারপরও তাদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্য প্রণোদীত হয়ে হয়রানির করার জন্য আইসিটি আইনে মিথ্যা মামলাটি দায়ের করা হয়েছে বলে দাবি করেন মামলার বিবাদি দুই সাংবাদিক। এভাবে মামলা হলে সঠিক মানুষকে সংবাদ পাওয়া থেকে বঞ্চিত করবে।বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রধান সম্পাদক ও নিউজ সময়.কমের সস্পাদক ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা সম্পাদকদের বিরুদ্ধে মামলায় সম্পাদকদের উদ্বেগ,অভিনব পদ্ধতি, সরাসরি থানায় গিয়ে সম্পাদক-সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাকে চাল-গম চোর, দুর্নীতিবাজদের উৎসাহ দেওয়ার ‘অভিনব পদ্ধতি’ বলে করছেন সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী ও হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, “গম চোর, চাল চোর, দুর্নীতিবাজদের মামলা করার মাধ্যমে উৎসাহ দেওয়ার একটা অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়েছে। মনজিল মোরসেদ বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করতে গেলে থানা থেকে বলে দেওয়া হয় যে, কোর্টে গিয়ে মামলা করতে হবে। কিন্তু যখন সত্য সংবাদ প্রকাশ করা হয়, তখন কিছু কিছু পুলিশ অফিসারের অতি উৎসাহে সরাসরি মামলা নেওয়া হয়।
“আইজিপির মাধ্যমে এই সমস্ত পুলিশ অফিসারদের সুনির্দিষ্টভাবে একটা নির্দেশনা দেওয়া দরকার, যাতে তারা সংবাদ মাধ্যমের কারও বিরুদ্ধে অর্থাৎ সংবাদ প্রকাশের কারণে মামলাগুলোর ব্যাপারে তড়িঘড়ি করে এফআইআর না করে। কারণ একটা এফআইআর হয়ে যাওয়ার পর কিন্তু একজন ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান আইনগত সমস্যায় পড়তে পারেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সব নাগরিকের জন্য প্রতিবন্ধক’ নিবর্তনমূলক বলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটির যে সমালোচনা, এসব মামলা তাই প্রমাণ করে বলে মন্তব্য করেন অধিকারকর্মী মনজিল মোরসেদ।“সত্য প্রকাশের জন্য যদি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়, তাহলে এই আইনটিকে আগে থেকেই যে বলা হচ্ছিল, এটি মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করবে, সেটিই কিন্তু আলটিমেটলি প্রমাণিত হচ্ছে। এটি হলে কিন্তু আলটিমেটলি এই আইনের অস্তিত্ব নিয়ে আদালতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে।”ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য হুমকি মনে করছেন সাংবাদিকরাডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য হুমকি মনে করছেন সাংবাদিকরা মনজিল মোরসেদ বলেন, “আমি মনে করি স্বাধীন, সত্য সংবাদ প্রকাশের জন্য কোনো সম্পাদক, সাংবাদিক, সংবাদ মাধ্যমকে যেন অযথা হয়রানি করা না হয়। এ ব্যাপারে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেন যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি বিবেচনা করেন।এদিকে তৌফিক ইমরোজ খালিদীসহ অন্যান্য সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ মামলার নিন্দা প্রতিবাদ জানিয়ে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি ওয়াকিল আহমেদ হিরণ ।
এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “আমরা সাংবাদিকরা সবসময়ই তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেই রিপোর্ট করে থাকি। কিন্তু মামলা করা হল। আসলে এটা খুবই দুঃখজনক। আমার মনে হয় যে, মামলাটি অবশ্যই প্রত্যাহার করা উচিত। এবং যারা এসব কর্মকান্ডের সাথে জড়িত তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। এলআরএফ সভাপতি হিরণ বলেন,কিছু লোক তো এসব করছেই। সরকারের লোকজন বা সরকার সমর্থিত লোকজন। আমি আশা করি, তারা মামলাটা প্রত্যাহার করবে। সরকার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
দৈনিক সমকালের এ জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক বলেন,“রিপোর্টে যদি ভুল হয়ে থাকে, তাহলে তারা প্রতিবাদ জানাতে পারে, আমরা সংশোধনী ছাপাবো। এমনকি কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়ারও সুযোগ আছে। কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়ার পর আমরা যদি ভুল সংশোধন না করি, তাহলে আপনি আমার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন। সে জন্য প্রেস কাউন্সিল আছে বা সংশ্রিষ্ট কর্তৃপক্ষ আছে। কিন্তু হঠাৎ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে দেওয়া আমাদের কাজের স্পৃহাকে বাধাগ্রস্ত করা এবং এটি সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ বলে আমি মনে করি।সম্পাদকদের বিরুদ্ধে মামলায় উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতিও দিয়েছে ল’ রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ)। সোমবার এক বিবৃতিতে এলআরএফ সভাপতি ওয়াকিল আহমেদ হিরণ ও সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আহসান রাজু বলেন, এই সঙ্কটকালেও সংবাদকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ভুয়া ও গুজব ছড়ানো তথ্যের ভিড়ে সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য নিশ্চিত করছে, যার সুফল সুফল পাচ্ছে জনগণ। বিবৃতিতে তারা এসব মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।