বেশিদিন আগের কথা নয়, গতবছরের ৩ আগস্ট শরফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান ও মাসুদুল ইসলাম ওরফে জিসান নামে দুই যুবককে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, মাদক ও ভারতীয় জাল রুপিসহ গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। গ্রেপ্তারের পর র্যাব জানায়, ঢাকার অভিজাত এলাকায় রাতে পার্টি আয়োজনের নামে মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন ধরণের অবৈধ কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ১০-১২ জনের একটি চক্র গড়ে তুলেছেন মিশু ও জিসান। পরে মিশুর বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও পর্নোগ্রাফি আইনে পৃথক তিনটি এবং জিসানের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি ও পর্নোগ্রাফি আইনে আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে খোদ র্যাবের এত অভিযোগ সেই মিশু ও জিসান গ্রেপ্তারের ৪ মাসের মধ্যেই আইনের ফাঁক গলে জামিনে বেরিয়ে এসেছেন। এরপর একজন পালিয়ে বিদেশে গিয়ে আরেকজন দেশেই অবস্থান নিয়েই নিজেদের চক্রের সদস্যদের সক্রিয় করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাসহ চক্রের পুরাতন কয়েকজনের পরিচয় ফাঁস হয়ে যাওয়ায় নতুন সদস্যও সংগ্রহ করছেন তারা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের শুরুতে জামিন পাওয়ার পরপরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে চলে যান জিসান। আর শরফুল হাসান ওরফে ছোট মিশু অবস্থান করছেন দেশেই। মিশু দেশে থেকে মাদক এবং অস্ত্র চোরাচালানের নেটওয়ার্কটি আবারও সক্রিয় করতে কাজ করছেন। এক্ষেত্রে কাজে লাগাচ্ছেন জিসানের মালিকানাধীন ডেইরি সান এগ্রো নামে একটি ফার্মকে। বিদেশ থেকে উন্নতজাতের গরু আমদামির নামে গরুর পেটে করে হীরা, সোনার পাশাপাশি ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান ফের শুরু করেছেন তিনি। আর জিসান বিদেশে বসে চোরাইপথে বিলাসবহুল গাড়ি বাংলাদেশে পাঠাচ্ছেন। সেসব গাড়ি প্রভাবশালীদের কাছে বিক্রির করছেন মিশু। গতমাসেই ঢাকার বারিধারায় জব্দকৃত একটি বিলাসবহুল রোলসরয়েস মিশু-জিসান সিন্ডিকেটের সহায়তাতেই বাংলাদেশে এসেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও পলাতক জিসান বিদেশে বসে নিয়মিতই ডিজে পার্টির নামে অশ্লীল পার্টির আয়োজন করছেন। মাদক ও যৌনতায় ভরা ওসব পার্টিতে অংশগ্রহণ জন্য কৌশলে বাংলাদেশের প্রভাবশালীদের প্রলুব্ধ করছেন মিশু।
জানা গেছে, শরফুল হাসান ওরফে ছোট মিশু ঢাকার মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের নেয়ামত উল্লাহ ও ফরিদা বেগমের ছেলে।কৈশর বয়সেই ছিনতাইসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি, গড়ে তোলেন কিশোর গ্যাং। মাদক ব্যবসা ও ছিনতাইয়ের অভিযোগে ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন মিশু। কয়েক মাস জেলে খেটে বেরিয়ে অবৈধ পথে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান তিনি।সেখানে বসেই বাংলাদেশী-তালিকাভুক্ত অপরাধীদের সাথে একটি বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন মিশু। এরপর ‘ইয়াবা’ (মেথামফেটামিন) ব্যবসা, সোনা-হীরা চোরাচালান এবং নকল ডলার উৎপাদন ও চোরাচালান করে অল্পসময়েই বিপুল অর্থের মালিক মনে যান। কয়েকবছর পর বাংলাদেশে ফিরে ব্যক্তিগত লেট নাইট পার্টি (ডিজে পার্টি) আয়োজন শুরু করেন।পার্টির আড়ালে দেশ-বিদেশে নারী ও মাদক সরবরাহ করতেন তিনি। শুধু তাই নয়, পার্টিতে অংশগ্রহণকারীদের বিভিন্ন অন্তরঙ্গ মূহুর্তের গোপন ভিডিও ধারণ করে বিত্তবানদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মিশু।এত অপরাধ করেও দীর্ঘদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখে পড়েননি তিনি। অবশেষে গত বছরের ৩ আগস্ট কুখ্যাত মডেল পিয়াসাকে গ্রেপ্তারের পর তার জবানবন্দিতে উঠে আসে মিশু ও জিসানের নানা কুকীর্তি। পরে ওই দিন রাতেই মিশু ও জিসানকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এসময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় একটি আগ্নেয়াস্ত্র, ৬ রাউন্ড গোলাবারুদ, ১৩ হাজার ৩০০ পিস ইয়াবা, একটি ফেরারি গাড়ি, সিসার সরঞ্জামাদি, ২টি ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, বিভিন্ন ব্যাংকের চেকবই ও এটিএম কার্ড, পাসপোর্ট এবং জাল ভারতীয় রুপি। পরে র্যাবের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে মিশু তার সব অপরাধ স্বীকার করে।
অন্যদিকে মিশুর সহযোগী জিসান পাবনা সদর উপজেলার রফিকুল ইসলামের সন্তান। মিশুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী জিসান নিজের পরিচয় দেন ডেইরি সান এগ্রো নামে একটি খামারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে। মূলত এই খামারই জিসান ও মিশু গংয়ের মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের মূল কেন্দ্র। থামারের জন্য বিদেশ থেকে আমদানি করার নামে গরুর পেটে করে হীরা-সোনা, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের রমরমা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন তারা।
এখানে কমেন্ট করুন: