মো.শফিকুল ইসলাম মতি,নরসিংদী:নরসিংদীর ঘোড়াশাল পলাশ এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে বালুর ভরাাট করে স্থাপনা নির্মান করায় প্রাণ গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।শীতলক্ষ্যার নদীর বিশাল জমি দখল করে স্থাপনা করেছে দেশের অন্যতম এই শিল্পগোষ্ঠী।গুরুত্বপূর্ণ নদীটির বেশ কিছু অংশ গিলে খাচ্ছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ।দখলের এক অংশ নরসিংদীর পলাশ উপজেলার কাজীরচর মৌজায়। আর অন্য অংশ রাজধানীর খিলক্ষেত থানার পাতিরা মৌজায়। দখল হওয়া জমির বাজারমূল্য ৩০০ কোটি টাকার বেশি বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী।

প্রাণ গ্রুপের বিরুদ্ধে পণ্য ওঠানামার অস্থায়ী অনুমতি নিয়ে নদী দখল করে স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। নদীর জমি দখল করায় প্রাণ গ্রুপের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। শীতলক্ষ্যার জমি দখলের অভিযোগে গত ১০ মে নরসিংদীর ঘোড়াশাল নদীবন্দরের উপপরিচালক আবু ছালেহ মোহাম্মদ এহতেশামুল পারভেজ পলাশ থানায় মামলাটি দায়ের করেছেন। কারখানার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা পর খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাণ গ্রুপ বিভিন্ন নামে শীতলক্ষ্যার জমি দখল করে বেশ কয়েকটি শিল্পকারখানা গড়ে তুলেছে।অন্যদিকে, ২০২১ সালের ২৪ অক্টোবর বিআইডব্লিউটিএর টঙ্গী নদীবন্দরের সহকারী পরিচালক রেজাউল করিম বালু দিয়ে নদের জায়গা দখলের অভিযোগে খিলক্ষেত থানায় ও একটি মামলা দাখিল করেন। অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হওয়ায় পুলিশ আদালতে চার্জশিট দিলেও মামলার তেমন অগ্রগতি নেই বলে জানা জায়।

দখল করা জমিতে রাতারাতি গড়ে উঠেছে একের পর এক ভবন। নদী দখলের বিষয় জানিয়ে অনুলিপি দেওয়া হলেও সরকারি সংস্থাগুলো গ্রুপটির বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেনা। উল্টো দখলের পক্ষে সাফাই গেয়ে প্রাণ গ্রুপ বলছে, তারা নদের জমি নিয়ম মেনে লিজ নেওয়ার আবেদন করেছে। তা ছাড়া নরসিংদীর বেশিরভাগ শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণ হয়েছে নদের তীর ঘেঁষে। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সুবিধার্থে নদের জায়গা বরাদ্দ না দিলে রাজস্ব হারাবে সরকার। যদিও নদের জমি লিজ দেওয়ার কোনো বিধান নেই। বিআইডব্লিউটিএ বলছে, মালপত্র ওঠানামার জন্য নদের জায়গা ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে শেষ পর্যন্ত শিল্পকারখানা নির্মাণ করছে প্রাণসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান।

গত ২৯ মে পূর্বাচলের পিঙ্ক সিটি হয়ে ডুমনি বাজারের সামনে পাতিরা মোড়ের এলাকায় সরেজমিন দেখা যায়, নদের তীর ঘেঁষে নতুন করে গড়ে তোলা হয়েছে প্রাণ গ্রুপের পাতিরা প্রকল্প।স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বর্ষায় পানি বাড়লে প্রাণ গ্রুপের প্রকল্প সীমানার প্রচির না থাকলে নদের প্রবাহ তৈরি হতো। মাটি ভরাট করে নদের জমিতে প্রাচির নির্মান করায় এখন আর সেই সুযোগ থাকছে না। দেয়ালের কাছাকাছি দেখা গেছে ছোট ছোট বেশ কয়েকটি পিলার।

এরকম পিলার আশপাশে চোখে পড়েনি। সব মিলিয়ে দখলের কারণে নদের স্বাভাবিক গতিপথও আগের মতো নেই বলছেন স্থানীয়রা।স্থানীয়দের বক্তব্য, এই জমি ১০ বছরের বেশি সময় ধরে একটু একটু করে দখল শেষে ভরাটের পর একে একে ভবন নির্মাণ করছে প্রাণ গ্রæপ। নদের পাড় থেকে কাঁচা রাস্তা ধরে সামনে গিয়ে দেখা গেছে, সড়কের শেষ প্রান্তেই কারখানার অবস্থান। এরপর আর সামনের দিকে যাওয়ার সুযোগ নেই। এই রাস্তার দুপাড় মিলিয়ে লাল টিনের ছাউনিতে নির্মাণ করা হয়েছে কমপক্ষে আটটি ভবন। সামনের অংশে বাউন্ডারি নেই। রয়েছে ১০ মিটার উঁচু একটি খোলা গেট।সামনে বিস্তর জায়গা থাকলেও ভবনগুলোর পেছনের অংশ নদের জমিতে। খালি জমিতে ফেলা হচ্ছে পুরোনো নির্মাণ সামগ্রী।

ভেতরে বেশকিছু শ্রমিককে কাজ করতে দেখা গেছে। শুধু প্রাণ গ্রæপ নয়, পাতিরা মৌজায় নদের উভয় পাড়ে বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগতভাবে নদের জমি দখলের রীতিমতো উৎসব চলছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, দখলের কারণে দিন দিন নদী ছোট হচ্ছে।প্রাণ গ্রুপের পাতিরা কারখানার কেউ দখলের ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি হননি। গেটের পাশে থাকা লোকজনও সব প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন।গ্রুপটির বিরুদ্ধে নদীর জমি দখলের দুটি অভিযোগের পাওয়া গেছে। পলাশ থানায় দায়ের করা অভিযোগে বলা হয়েছে, উপজেলার কাজীরচর মৌজায় অবস্থিত প্রাণ-আরএফএলের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মাল্টিলাইন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-২ অবৈধভাবে মাটি/বালু/রাবিশ/প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরভূমি ভরাট করছে।

অধিকতর ভরাটের নদীর জমিতে ডাইক তৈরি করা হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরতদের ভরাট অংশসহ ডাইক অপসারণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।ঘোড়াশাল নদীবন্দরের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রথীন্দ্র নাথ পালের নাম এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের নদী ও নদীর তীরভূমি তথা নিম্নাঞ্চল ভরাট/ক্ষতিগ্রস্ত করার এরূপ কার্যকলাপ যা হাইকোর্টের রিট পিটিশন নং-৩৫০৩/২০০৯-এর নির্দেশ, এই রায়ের ধারাবাহিক আদেশগুলো-বন্দর আইন-১৯০৮, বন্দর বিধি-১৯৬৬, ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স-১৯৭৬-এর সংশ্লিষ্ট ধারা, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০০০) ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিধি ১৯৯৬ ও পেনাল কোডের ৪৩১ ধারা অমান্যের শামিল।হাইকোর্টের রিট পিটিশন নম্বর ৩৫০৩/২০০৯-এর নির্দেশনায় নদী দখলদার উচ্ছেদসহ নদীকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা এবং বালু ফেলে বা অন্য কোনোভাবে নদী ভরাট সম্পূর্ণ বন্ধ রাখার আদেশ দেওয়া হয়েছে। বন্দর আইন-১৯০৮, বন্দর বিধি-১৯৬৬-এর সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী ঘোষিত বন্দর সীমানার মধ্যে বিআইডব্লিউটিএর অনুমতি ছাড়া কোনো কার্যক্রম গ্রহণ বা স্থাপনা নির্মাণ সম্পূর্ণভাবে অবৈধ। আলোচ্য প্রতিষ্ঠানের শীতলক্ষ্যা নদী ধ্বংসকারী এরূপ কার্যকলাপে নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় নৌপথ সংকুচিত ও পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে এবং নৌ দুর্ঘটনার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়।অবৈধভাবে নদীর জমি দখলের কারণে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে এজাহার (মামলা) গ্রহণ করে নদী ও নদীর তীরভূমি তথা নিম্নাঞ্চল ভরাট/ক্ষতিগ্রস্থ করায় ইনল্যান্ড লিপিং অর্ডিন্যান্স-১৯৭৬, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ (সংশোধিত-২০১০-এর ১৫(১) এর টেবিল-৮ ও পেনাল কোডের ৪৩১ নম্বর ধারা অনুযায়ী কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

জানা গেছে, প্রাণ গ্রæপের দখল করা জমি বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান পরিদর্শন করেছেন। এ সময় বিআইডব্লিউটিএর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রণালয়কেও জানানো হয়েছে। এজাহারের অনুলিপি দেওয়া হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক, জেলা প্রশাসক/পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তির দপ্তরে।এজাহারের বাদী বিআইডব্লিউটিএ ঘোড়াশাল নদীবন্দরের উপপরিচালক আবু ছালেহ মোহাম্মদ এহতেশামুল পারভেজ বলেন, মাল্টিলাইন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-২ অবৈধভাবে শীতলক্ষ্যা নদীর জমি ভরাট করায় পলাশ থানায় এজাহার দাখিল করা হয়েছে। এরপর প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে আমাদের কাছে কিছু কাগজপত্র ও ছবি পাঠানো হয়।

এতে বলা হয়েছে দখল সরিয়ে নেওয়া হবে।এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দখল সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি প্রাণ গ্রæপ। সব আগের অবস্থাতেই রয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী দখলে গেছে ১২০/৫০ বর্গফুট জমি।জানতে চাইলে প্রাণ-আরএফএলের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মাল্টিলাইন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-২-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রথীন্দ্র নাথ পাল যুক্তি বলেন, নরসিংদীর বেশিরভাগ কলকারখানা নদীর পাড়ে। আমরা নিজস্ব জমিতে প্রতিষ্ঠান করেছি। এর মধ্যে নদীর কিছুটা অংশও রয়েছে। সবুজ জমি নষ্ট করিনি, তবে প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হচ্ছে। শীতলক্ষ্যার জমি নষ্ট না করার দাবি করে তিনি বলেন, নদীর জমি ব্যবহারে আইন মেনে লিজ নেওয়ার আবেদন করা হয়েছে।

লিজ চূড়ান্ত হয়নি। এ ব্যাপারে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কালক্ষেপণ করার অভিযোগ করে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আবেদনের পর বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে জরিপ করে জমি লিজ দেওয়ার পক্ষে মতামত দেওয়া হলেও নানা কারণে তা চূড়ান্ত হচ্ছে না। ফলে সরকার জমির রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃৃপক্ষ দ্রæত সময়ের মধ্যে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।এদিকে, রাজধানীর খিলক্ষেত থানায় দায়ের করা এজাহারে বলা হয়েছে, টঙ্গী নদীবন্দরের নিয়ন্ত্রণাধীন খিলক্ষেত থানার পাতিরা মৌজায় বালু নদের পশ্চিম পাশে জমি দখল করা হয়েছে। এ মৌজায় ২৮, ২৯ ও ৩০ সীমানা পিলারের অভ্যন্তরে প্রাণ-আরএফএল গ্রæপ সাড়ে ১২ হাজার বর্গফুট বালু নদের তীরভূমিসহ নদ ভরাট করেছে বলে থানায় লিখিত এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০২১ সালে ২৪ অক্টোবর এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে অভিযানের সময় কাউকে আটক করা যায়নি।

এজাহারে দখলের সঙ্গে যুক্ত প্রাণ-আরএফএল গ্রæপের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) ফয়সাল মাহমুদ, আরেক ম্যানেজার (প্রশাসন) সরওয়ার জাহান, এমভি তিথী ড্রেজারের মালিক জাহেদ আলী, মদিনার পথের স্বত্বাধিকারী মুক্তারসহ অজ্ঞাতপরিচয় ৮-১০ ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা হয়। এজাহারে বলা হয়েছে,আসামিদের এরূপ কার্যকলাপের ফলে নদী ভরাট হয়ে যাওয়া, নৌপথ সংকুচিত, পরিবেশ বিপন্ন, নৌ দুর্ঘটনা বৃদ্ধি, সরকারি সম্পত্তি দখল, সীমানা পিলার স্থাপনে বাধা, নদীর ক্ষতিসাধন, সীমানা পিলারের লেআউট নষ্ট করা, অপরাধমূলক ভীতি প্রদর্শন এবং বেআইনি তীরভূমি অবৈধভাবে ভরাট, দখল করার কার্যক্রম আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। এ অবস্থায় আইনের বিভিন্ন ধারা উল্লেখ করে আসামিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা এজাহারে উল্লেখ করা হয়।এজাহারটি টঙ্গী নদীবন্দরের সাবেক সহকারী পরিচালক রেজাউল করিম দাখিল করলেও বর্তমানে তিনি বদলি হয়ে ভৈরবের আশুগঞ্জে দায়িত্ব পালন করছেন। টঙ্গীতে তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন সহকারী পরিচালক মো. শাহ আলম মিয়া।

তিনি বলেন, এজাহার দাখিল করার পর আমি এই বন্দরের দায়িত্বে এসেছি। শুনেছি এজাহারের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর কোর্টে একটি শুনানি হয়েছিল। আর কোনো অগ্রগতি সম্পর্কে আমার জানা নেই। নদীর জমি দখলমুক্ত হয়েছে কি না, তাও জানা নেই। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি বালু নদ পরিদর্শনে যাননি বলেও জানান।প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসান খান চৌধুরীর মোবাইল ফোনে কয়েকবার কল দিলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে। গ্রুপের পরিচালক (মিডিয়া) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, পাতিরা মৌজায় বালু নদে সীমানা পিলারের বাইরে আমাদের কারখানা নির্মাণ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে পরে বিস্তারিত জানাবেন বলেও জানান তিনি।

এখানে কমেন্ট করুন: