কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল দুর্নীতির কারখানা হিসেবে পরিণত হয়েছে। প্রতিষ্ঠান না থাকলেও হাসপাতালের ঠিকাদারি কাজ পাচ্ছেন স্থানীয় ব্যক্তিরা। সেই সঙ্গে সরকারি ওষুধ পাচার হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন মূল হোতারা। হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে বিনামূল্যের ওষুধ অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে কিনতে হয় রোগীদের। হাসপাতালের কম্বল-মশারি ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র না পেয়ে ভোগান্তি পোহান রোগী ও তার স্বজনরা।অনুসন্ধানে জানা যায়, ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে প্রতিদিন শত শত রোগী সেবা নিতে আসেন। এদের মধ্যে অনেকে ভর্তি হন আবার কেউ বাড়ি চলে যান। ভর্তি হওয়া রোগীদের জন্য সরকারের দেয়া কম্বল, চাদর ও বালিশের কাভার দেয়ার নিয়ম থাকলেও সেগুলো দেয়া হয় না।সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে শীতেও বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। শীতের সময় হাসপাতালের মেঝেতে থাকলেও রোগীদের মিলছে না কম্বল ও বালিশের কাভার। যদি কোনোভাবে মেলে সেটি হয় দুর্গন্ধযুক্ত না হয় ময়লাযুক্ত। ফলে হাসপাতালে রোগী ভর্তি করে অনেকে বাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে শীত নিবারণের কাঁথা, কম্বল এবং লেপ-তোশক নিয়ে আসেন।
এদিকে প্রতিষ্ঠান না থাকলেও অসাধু উপায়ে মানিক লন্ড্রি এবং সাদেক লন্ড্রি নামে দুই অদৃশ্য প্রতিষ্ঠান হাসপাতালের ঠিকাদারি কাজ পায়। ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য সহযোগিতা করেন হাসপাতালের হিসাবরক্ষক আশরাফ মজিদ। এ কাজের জন্য মানিক লন্ড্রি এবং সাদেক লন্ড্রি নামে দুই অদৃশ্য প্রতিষ্ঠান থেকে মাসোয়ারা নেন আশরাফ মজিদ।অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, প্রতি মাসে হাসপাতালের কাপড়-চোপড়, কাঁথা, কম্বল এবং লেপ-তোশক ধোয়ার কাজের জন্য মোটা অঙ্কের বিল উত্তোলন করছেন ঠিকাদার। এই টাকার ভাগ নেন আশরাফ মজিদ। হাসপাতালের বিভিন্ন কাজে এভাবে দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকার পাহাড় গড়েছেন তিনি।
পৌর শহরের গস্তিপাড়ায় প্রায় ৬০ লাখ টাকা দিয়ে দুটি জমি কিনে একটিতে পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করেছেন। যার মূল্য প্রায় দুই কোটি টাকা। ২০১৭ সালে প্রায় ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে গ্রামের বাড়িতে ৮০ শতক জমি কেনেন তিনি।
হলোখানা ইউনিয়নের এক জনপ্রতিনিধি বলেন, আশরাফ মজিদ সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের টাপুরচর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত প্রাইমারি শিক্ষক বহিয়ত উল্লাহ মাস্টারের ছেলে। তার বাবার ১০ বিঘার মতো সম্পত্তি রয়েছে। এই সম্পত্তির অংশীদার ছয় ভাই-বোন। কিন্তু হঠাৎ করে আশরাফ মজিদ শহরে জায়গা কিনে বাড়ি করেছেন। হঠাৎ কীভাবে তিনি এত টাকার মালিক হলেন তা নিয়ে সবাই অবাক। অথচ তার পরিবারের এমন কোনো সদস্য নেই তাকে জায়গা-জমি কেনার জন্য মোটা অর্থ সহযোগিতা করবেন।অনুসন্ধানে জানা যায়, হাসপাতালের বিল সিটে প্রতিটি কম্বল ধোয়ার বিল ১১ টাকা, চাদর ১৭ টাকা, বালিশের কাভার সাত টাকা, মশারি পাঁচ টাকা, দরজা ও জানালার পর্দা চার টাকা এবং তোয়ালে তিন টাকা করে দর দেয়া রয়েছে।
হাসপাতালের বিল সিটে দেখা যায়, কাপড়-চোপড় ধোয়ার কাজে শীত ও গ্রীষ্মকালীন প্রতি মাসে গড়ে ঠিকাদার প্রায় দেড় লাখ টাকা করে উত্তোলন করছেন। জেনারেল হাসপাতালের ১০০ শয্যা রাজস্ব খাত এবং ১৫০ শয্যার জন্য উন্নয়ন খাত থেকে ঠিকাদারকে এ বিল দেয়া হয়।
এ বিষয়ে ঠিকাদার মানিক মিয়া বলেন, দুই বছর ধরে হাসপাতালের কাপড়-চোপড়, কাঁথা-কম্বল, লেপ-তোশক ধোয়ার ঠিকাদারি কাজ করছি।
অথচ সরেজমিনে দেখা যায়, ঠিকাদার মানিক মিয়া তার বাড়ির পুকুরের পাশে হাসপাতালের কাপড়-চোপড় ও কাঁথা ধুয়ে রোদে শুকাতে দিয়েছেন। কিন্তু সেখানে কোনো লেপ-তোশক ও কম্বল ছিল না।
মানিক লন্ড্রি নামের প্রতিষ্ঠানটি শহরের দাদামোড়ে থাকার কথা মানিক মিয়া জানালেও তার ভাই সাদেক বলেন, বর্তমানে লন্ড্রি প্রতিষ্ঠান না থাকলেও আগে ছিল।
মানিক মিয়া আরও বলেন, আমার এবং আমাদের স্বজনের কাছ থেকে তিন বছর আগে প্রায় ৬০ লাখ টাকা দিয়ে জমি কিনেছেন হিসাবরক্ষক আশরাফ মজিদ। শহরে বাড়িও বানিয়েছেন।সরেজমিনে দেখা যায়, শহরের দাদামোড়ের ঠিকানায় মানিক লন্ড্রি এবং সাদেক লন্ড্রি নামে দুই প্রতিষ্ঠানকে হাসপাতালের ঠিকাদারির কাজ দেয়া হলেও বাস্তবে দুই প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই।
দাদামোড়ের লন্ড্রি ব্যবসায়ী সালাম বলেন, আমি আট বছর ধরে এখানে লন্ড্রির ব্যবসা করছি। এখানে মানিক লন্ড্রি এবং সাদেক লন্ড্রি নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, আর ছিলও না।
সম্প্রতি হাসপাতালের ওষুধ পাচারকালে মোসলেমা ও রোসনা বেগম নামে দুইজন নারী পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন। কিন্তু পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের এক কর্মকর্তা ও সিনিয়র নার্স বলেন, হাসপাতালের ওয়ার্ড ইনচার্জ অনেকেই আছেন, দীর্ঘদিন ধরে এই পদটি ধরে আছেন। তারা রোগীদের সরকারি ওষুধ না দিয়ে বাইরে থেকে কিনে নিয়ে আসতে বলেন। আর ওই ওষুধগুলো বিতরণ দেখিয়ে বহিরাগত নারী-পুরুষদের দিয়ে পাচার করেন তারা।তারা আরও বলেন, হাসপাতালের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে একটি চক্র নিয়মতি ওষুধ পাচার করেন। হাসপাতালের প্রধান সহকারী ইউনুস আলীর বিরুদ্ধে নভেম্বর মাসে ৯০ জন নার্স হাসপাতালে যোগদানকালে তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১০০০ টাকা করে নেয়ার অভিযোগ আছে।
এসব বিষয়ে হাসপাতালের হিসাবরক্ষক আশরাফ মজিদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনি আমাকে চেনেন। আমার সম্পর্কে জানেন। আপনাকে কোনো তথ্য দিতে আমি বাধ্য নই। এই জেলার ৪০০ সাংবাদিকের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। আমার বিরুদ্ধে লিখলে কিছুই হবে না।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে মাসোয়ারা ও হাসপাতালের দুর্নীতির টাকার বাড়ি বানিয়েছেন এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ২৩ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছি আমি।এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আনোয়ারুল হক প্রামাণিক বলেন, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে নিয়ম মাফিক কাজ দেয়া হয়েছে।
হাসপাতালের কাপড়-চোপড় ধোয়ার কাজ না করেও নিয়মতি বিল উত্তোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই বিলগুলো চেক করেই আমার কাছে আসে। সে হিসেবে আমি বিলের কাগজে সই করে থাকি।