নিজস্ব প্রতিবেদক:
চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলীতে নিকাহ্ রেজিস্ট্রার নিবন্ধনের দায়িত্ব নিয়ে দুই কাজীর পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ও অসংগতিপূর্ণ বক্তব্যের কারণে জনমনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।
পক্ষ বিপক্ষে এলাকায় নানা লিপলেট বিতরণ করায় জনগণও বিভ্রান্তিতে । ফলে সরকারি নিবন্ধনে বিয়ে পড়া নিয়ে পড়েছে বিপাকে তিন গ্রামের ৩৫হাজার মানুষ। এনিয়ে এলাকায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
তথ্যমতে জানা যায়, ২০০৭ সালের ফ্রেবুয়ারিতে ১নং (খ) চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের তৎকালিন কাজী মৌলানা নুরুল হুদা অবসরে যান। অবসর গ্রহণের কিছুদিন পরে মারা যান তিনি।
একই বছরের ১৪মার্চ জেলা রেজিস্ট্রার পটিয়া উপজেলার ৫নং হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের শরফুদ্দীন মোঃ সেলিমকে চরপাথরঘাটা শুন্য পদে ১৯৪১/১(৬) নং স্মারকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেন। ২০১০ সালের ২৬ মে উক্ত কাজীর অতিরিক্ত দায়িত্ব শেষ হয়।
পরবর্তীতে প্রয়াত সংসদ সদস্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর সুপারিশে ২০১১ সালের ২১শে আগষ্ট ৫৫৯০(৭)নং স্মারকে ১নং চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের নিকাহ্ রেজিস্ট্রার সৈয়দ মোঃ নজরুল ইসলামকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেন।
তার এক মাস যেতে না যেতেই পুর্বে অবসর প্রাপ্ত কাজী মৌঃ নুরুল হুদার পুত্র আবদুল্লাহ আল মামুনের করা ৭৯৮৫/০৯ইং রিটে সে দায়িত্ব স্থগিত হয়ে যায়। পরবর্তীতে কাজী সৈয়দ মোঃ নজরুল ইসলাম ৫২৯১/১০ইং রিট করে হাইকোর্ট থেকে সাব রেজিস্ট্রার এর ওই আদেশ স্থগিতাদেশ খারিজ করে দেন। এবং পুনরায় ২০১১সালের ২১আগষ্ট অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনে জেলা রেজিস্ট্রার হতে নির্দেশ পান।
এরইমধ্যে, পোষ্য কৌটায় অবসর প্রাপ্ত কাজীর ছেলে আবদুল্লাহ আল মামুন রিট করে এই শুন্য পদে নিয়োগ পেতে চেষ্টা করেন। এবং আদালত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কাউকে স্থায়ী নিয়োগ না দিতে নির্দেশনা দেন। এক্সটেনশন অবস্থায় হাইকোর্টে ওই মামলা চলমান রয়েছে বরৈ জানা যায়।
অন্যদিকে কাজী শরফুদ্দীন মোহাম্মদ সেলিম দাবি করছে, সে চরপাথরঘাটা ইউনিয়নে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছে। যদিও ১৯৭৫ সালের বিধি ২ মতে মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রীকরণ আইনের রয়েছে, কারো অতিরিক্ত দায়িত্বকাল ৬০ দিনের জন্য বরাদ্দ থাকিবে, ৬১তম দিনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শুন্য হইয়া যায়।
তাহলে মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ কিংবা মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রীকরণ আইনের কোনটাই কি মানা হচ্ছেনা কাজীর অতিরিক্ত দায়িত¦ পালনে?
এদিকে অতিরিক্ত দায়িত্বের নামে কাজীরা দেদারছে আয় করছে অতিরিক্ত টাকা। যা সম্পুর্ণ অবৈধ বলে দাবি তুলেছে এলাকাবাসী । কোন নিবন্ধন বইতে বিয়ে পরাচ্ছে তা কেহ জানেনা। এর মধ্যে কাজী সৈয়দ মোঃ নজরুল ইসলাম ও কাজী শরফুদ্দীন সেলিম একে অপরের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার ও নানা বিতর্কিত লিপলেট বিতরণ করছে এলাকায়। এমনকি সংর্ঘষসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাল্টাপাল্টি নানা অভিযোগ ও চলছে। যা অনেকটা তদন্তাধীন। এদিকে দুই কাজীর দলাদলিতে সমস্যায় পড়েছে সাধারণ জনগণ।
কেননা এখনো স্পষ্ট নয়,অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনে কে বৈধ আর কে অবৈধ কাজী। বিষয়টি জেলা রেজিস্ট্রারও অদৃশ্য কারনে আমলে নিচ্ছেনা বলে এক পক্ষের দাবি। জনগণ চায় বৈধ কাজীর অফিস বলবৎ থাকুক। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, অতিরিক্ত কাজী দাবিদার সেলিমের পক্ষে কামরুল নামক এক ব্যক্তি নিজেকে কাজী পরিচয় দিয়ে নকল জন্মসনদ ও নকল স্বাক্ষর দিয়ে বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন করে আসছেন। এমনকি নাবালিকা মেয়েদের সাবালক বানিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। মোদ্দা কথা একপ্রকার ভুয়া কাজী সে।
সুুত্রে জানা যায়, বেশ কিছুদিন যাবত এ নিয়ে এলাকার চেয়ারম্যান ও মেম্বারেরা নানা জটিলতায় পড়লে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে বিষয়টি অবগত করেন। পরে নির্বাহী কর্মকর্তা এ বিষয়ে জেলা রেজিস্ট্রারের কাছে চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের নিকাহ্ রেজিস্ট্রার এর তালিকা চান।
ফলে গত ১ মার্চ জেলা রেজিস্ট্রার ৪০৩ নং স্মারকে যে তথ্য প্রদান করে। তাতে দেখা যায়, চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের নিকাহ্ ও তালাক রেজিস্ট্রার পদ শুন্য। এমনকি মহামান্য হাইকোর্টের রিট পিটিশন নং ৭৯৮৫/০৯ইং ও কনটেম্পট পিটিশন ২৫১/১১ইং বিচারাধীন থাকায় অদ্যবধি নিয়োগ কিংবা অতিরিক্ত দায়িত্বের কোন আদেশ বর্ধিত করা সংক্রান্ত কোন কার্যক্রম গ্রহন করেনি বলে জানান। গুরুত্বর্পুণ বিষয়, তাহলে অতিরিক্ত দায়িত্বের নামে এরা কারা? যারা নিজেকে কাজী দাবি করে কার্যক্রম চালাচ্ছে।
জনগণও অভিযোগ তোলেছে, তাহলে কিসের উপর ভিত্তি করে চরপাথরঘাটা ইউনিয়নে কাজীরা অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছে। একই ব্যক্তি আবার পটিয়া উপজেলার ৫নং হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের নিকাহ্ রেজিস্ট্রার বলেও জানা যায়।
তথ্যমতে, ২০০১ সালে সরকার প্রণীত আইনে রয়েছে এক ইউনিয়নে একজন কাজী নিয়োগ এবং ওই ব্যক্তি হবে স্ব স্ব ইউনিয়নের স্থায়ী বাসিন্দা। কিন্তু কোন ধরনের নিয়ম নীতি তোয়াক্কা না করে, সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের গাফিলতি ও অবহেলার সুযোগকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে জনগণের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বিধি না মানা কাজীরা। যেন দেখার কেহ নেই।
কেননা বিবাহ নিবন্ধনের কোন আইনেই তারা মানছেনা। নেই কোন একসেস। ভুয়া জন্মসনদ ও জাতীয় পরিচয় যাচাই বাচাই ব্যতীত দেশের বিভিন্ন জায়গার বিবাহ পড়িয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার মতো অহরহ অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে।
তথ্যসুত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান চরপাথরঘাটা এলাকায় নতুন করে নিকাহ্ রেজিস্ট্রার এর আবেদন জানান। কিন্তু তৎকালিন জেলা রেজিস্ট্রার মোঃ আব্দুল কাইউম একই বছরের ২০শে মে ২৫৯৪ নং স্মারকে লিখিত প্রতিবেদনে রিট মামলা ও কনটেম্পট পিটিশনের এর কারণে নতুন করে স্থায়ী নিকাহ্ রেজিস্ট্রার নিয়োগ সম্ভব হচ্ছেনা বলে তথ্য দেন।
মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রিকরণ ২০০৭ সালের আইনের (১) ধারামতে জানা যায়, মৃত্যু, অবসর, ইস্তেফাজনিত বা অন্য কোন কারনে পদ শুন্য হলে পুরণ সংক্রান্ত আইনে বলা আছে, পার্শ্ববর্তী এলাকার নিকাহ্ রেজিস্ট্রারকে অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদানের। কিন্তু চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের পার্শ্ববতী ইউপি চরলক্ষ্যা হলেও কর্ণফুলীর উপজেলার সম্পুর্ণ বাহিরে ভিন্ন উপজেলা পটিয়ার কাজীকে দায়িত্ব দেয়া কতটা যুক্তিসংগত ও আইন পরিপন্থী কিনা তাও অভিযোগ ওঠেছে।
এ বিষয়ে সরেজমিনে জানা যায়, ২০০৭ সাল হতে শরফুদ্দীন মোঃ সেলিম নিকাহ্ রেজিস্ট্রির দায়িত্ব নিলেও কখনো নিয়মিত অফিসে আসেননি। গ্রামের অনেকে তাকে চিনেনও না বলে দাবি করছে। জুলধা ইউনিয়নের কামরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে যাবতীয় কাজকর্ম সম্পাদন করে বলে জানা যায়। তবে জনশ্রুতি রয়েছে কামরুল বিভিন্ন ভাবে জনগণকে হয়রানি করছে এবং সাধারণ জনগণকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
গত কয়েকদিন আগে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এসব অভিযোগে চরপাথরঘাটার কাজী অফিস তালা লাগিয়ে বন্ধ করে সাইনবোর্ড নিয়ে গেলে। বন্ধ থাকে প্রায় মাস দুয়েক।
পরে ২৭মে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এর সিনিয়র সহকারী সচিব বুলবুল স্বাক্ষরিত বিচার-৭/২এন-৮৪/৮৩(অংশ)-৩৪৩ স্মারকে জানা যায়,মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অন্য কাউকে অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদানসহ নিকাহ্ রেজিস্ট্রার নিয়োগ সমীচীন নয়। স্বভাবতই আসনটি শুন্য বলা যায়, কেননা কারো অতিঃ দায়িত্ব ৮বছর থাকেনা। বিষয়টি নিয়ে এলাকায় মারামারি ও সংঘর্ষ হলে স্থানীয় প্রশাসনও কোন সমাধা দিতে পারছেনা বলে জানা যায়।
পটিয়া ৫নং হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের কাজী শরফুদ্দীন মোঃ সেলিম সর্বৈব অস্বীকার করে জানান, “মহামান্য হাইকোর্টের কনটেম্পট ২৫১/১১ইং রিটের কারনে তিনি এখনো বহাল বলে দাবি করেন। তবে কোন কাগজ দেখাতে পারেনি। নিয়মিত অফিস করেন বলেও জানান।
অন্যদিকে চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের বরাদ্দকৃত ভলিয়াম ও সিল তার কাছে রয়েছে বলেও দাবি কওে কওে বসেন তিনি।
অন্যদিকে চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের কাজী সৈয়দ মোঃ নজরুল ইসলাম জানান, “কারো অতিরিক্ত দায়িত্ব ৮ বছর থাকেনা। আমি ও নেই সে অনুযায়ী। তবে কোন নিয়মে সে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে আমি বুঝিনা। ”
উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিজেন ব্যানার্জী জানান, “অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে যে আসুক না কেন। কাজী ছাড়া যেন কোন বিয়ে না পড়ান। যদি পড়ায় তবে তাঁকে জনগণ আটক করে যেন পুলিশে দেয়”।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা রেজিস্ট্রার নাজমা ইয়াসমিন জানান,“আইনের জটিলতার কারনে বিষয়টি নিয়ে তেমন ভাবা হয়নি। তবে দ্রুত এ বিষয়ে যাচাই বাচাই করে একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।