ধর্ষণের শিকার হয়ে ধর্ষকের বিরুদ্ধে নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানায় মামলা করতে এসেছিলেন এক এসএসসি পরীক্ষার্থী কিশোরী। কিন্তু, দু’দফায় ওই কিশোরী ও তার ভাইকে থানায় আটকে রেখে মামলা না নিয়ে উল্টো ভয় দেখানো এবং সাদা কাগজে স্বাক্ষর আদায় করে তাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাশেদুজ্জামানের বিরুদ্ধে। ৬ মাস আগের এই ঘটনা নিয়ে সোমবার (১৫ জুন) দুপুরে নেত্রকোনা জেলা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন ভিকটিমের স্বজনরা। এ সময় তারা জানান, বিষয়টি নেত্রকোনার এসপিকে জানিয়েও প্রতিকার না পাওয়ায় আইজিপি বরাবর গত ১০ জুন একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন তারা।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন ভিকটিমের ভাই। নিরাপত্তাজনিত কারণে তার পরিচয় প্রকাশ করছে না বাংলা ট্রিবিউন।

ভিকটিমের ভাই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলেন, চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি উপজেলার শান্তনগর সোহরাব মাস্টারের বাড়িতে আমার বোনকে একই উপজেলার ছিলিমপুর গ্রামের প্রভাবশালী মুকুল খানের ছেলে প্রিন্স খান বাবু ধর্ষণ করে। এ সময় খবর পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ধর্ষক প্রিন্স বাবু ও ধর্ষণের শিকার আমার বোনকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। এ ঘটনার পরদিন ৩০ জানুয়ারি আমি ধর্ষকের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে চাইলে ওসি রাশেদুজ্জামান প্রথমে তাতে সম্মতি দেন। কিন্তু, পরে অজ্ঞাত কারণে মামলা না নিয়ে আমাকে থানার একটি কক্ষে ১৪ ঘণ্টা আটকে রাখেন। এরপর আমাকে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘এ বিষয়ে মামলা করলে আমাকে ও আমার বোনকে মিথ্যা মামলা দিয়ে কোর্টে চালান করে দেবেন।’

এ সময় পুরো ঘটনার জন্য আমার বোনের ওপরে দায় চাপান ওসি রাশেদুজ্জামান। তিনি আমাকে শাসিয়ে আমার বোনের নামে অপবাদ দিয়ে বলেন, ‘তোর বোন খারাপ প্রকৃতির মেয়ে। সে পতিতার ব্যবসা করে।’ আমি এর প্রতিবাদ করলে আমাকে শাসাতে থাকেন তিনি। পরে আমার ও আমার কিশোরী বোনকে ডেকে এনে উভয়ের কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়ে আবারও শাসাতে শাসাতে থানা থেকে বের করে দেন।

ভিকটিমের ভাই সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, পরে বিষয়টি নেত্রকোনা পুলিশ সুপারকে অবহিত করলে তিনি বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিকে মামলা নেওয়ার নির্দেশ দেন। ফলে প্রতিকার না পেয়ে আবারও আমরা ওসি রাশেদুজ্জামানের পাল্লাতেই পড়ি।

ভিকটিমের ভাই আরও অভিযোগ করেন, এসপির নির্দেশের কারণে আরও ক্ষুব্ধ হন ওসি রাশেদুজ্জামান। এসপির নির্দেশে ওসি রাশেদুজ্জামান আমাকে ও আমার বোনকে ফোন করে থানায় মামলা নেওয়ার কথা বলে ডেকে নিয়ে যান। এরপর শুরু হয় আমার বোনের ওপর তার মানসিক নিপীড়ন। আমার বোনকে থানার একটি আলাদা কক্ষে দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখেন ওসি। এ সময় আমার বোনের সঙ্গে বাজে আচরণ করেন তিনি। ধর্ষণের শিকার হয়ে এমনিতেই সে মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল, এ অবস্থায় ওসি তাকে থানার ওই কক্ষে ৪৮ ঘণ্টা আটকে মানসিক টর্চার অব্যাহত রাখেন এবং গালাগাল করতে থাকেন ও তার চরিত্র নিয়েই বারবার প্রশ্ন তোলেন। একইসঙ্গে আরেক কক্ষে আমাকেও ৪৮ ঘণ্টা আটকে রাখেন। আর বারবার হুমকি দিয়ে আমাদের বলতে থাকেন, ‘তোর কত বড় সাহস আমার বিরুদ্ধে এসপির কাছে অভিযোগ করিস?’ এভাবে মামলা করার নামে ডেকে নিয়ে আমাকে ও আমার বোনকে ৪৮ ঘণ্টা থানার ভেতরে আটকে রাখার পরে আবারও পৃথক দুটি সাদা কাগজে আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বাক্ষর নেন। এরপর বলেন, ‘তোরা এখন যা, মামলা নেওয়া হবে।’

কিন্তু ঘটনার ৬ মাস পেরিয়ে গেলেও অভিযোগটি মামলা আকারে অন্তর্ভুক্ত করেননি ওসি রাশেদুজ্জামান।

ভিকটিমের ভাই বলেন, দেশে করোনা পরিস্থিতির কারণে আমরা আদালতে গিয়ে মামলা দায়ের করতে পারিনি। ধর্ষক এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তির ছেলে হওয়ায় তার ভয়ে আমরা ৬ মাস যাবৎ আতঙ্কে দিন পার করছি, পালিয়ে থাকছি।

সংবাদ সম্মেলনে আপন বোন ধর্ষণের শিকার হওয়ার পরেও ন্যূনতম মামলা করতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে এই ব্যক্তি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার বোন আমাকে জানিয়েছে ওসি রাশেদুজ্জামান তাকে থানার ভেতরে ডেকে নিয়ে খারাপ ভাষায় গালি দিয়েছে। সে তার মেয়ের মতো এমন কথা বলেও নিস্তার পায়নি। ওসি তাকে খারাপ গালাগাল করে এবং ধর্ষকের পক্ষে নানা কথা বলে।’

সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও জানান, ধর্ষক প্রিন্স এলাকার প্রভাবশালী হওয়ায় একটি মহলের অনুরোধে বিশেষ সুবিধা নিয়ে বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছেন ওসি সাহেব।

তাই এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, মামলা দায়েরের সুযোগ এবং ওসির এমন নোংরা আচরণের বিচার প্রার্থনা করে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বরাবরে গত ১০ জুন একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন বলে জানান তিনি।

পরে ভিকটিমের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ‘আমার মতো এমন ধর্ষণের শিকার যেন কেউ না হয়। আমি ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। আর আমাকে কেন কেন্দুয়া থানার ওসি রাশেদুজ্জামান এমন বাজে কথা বললো এবং ধর্ষণের শিকার হওয়ার পরেও আমার অভিযোগ কেন নিলো না তার বিচার চাই।’

এ বিষয়ে কেন্দুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাশেদুজ্জামানকে একাধিকবার তার সরকারি মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

জানতে চাইলে নেত্রকোনা পুলিশ সুপার আকবর আলী মুন্সি বলেন, সংবাদ সম্মেলনের খবরটি শুনেছি। যেহেতু বিষয়টি অনেক দিন পূর্বের তাই খোঁজ খবর নিয়ে তারপর পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। সুত্র:বাংলা ট্রিবিউন

এখানে কমেন্ট করুন: