স্টাফ রিপোটার:হাইকোর্টে আসা বিচারপ্রার্থীদের কাছে,তদবির, শব্দটি কমবেশি পরিচিত।আর এই তদবির হলো আর্থিক লেনদেন বা ঘুষ। তদবির করা না গেলে মামলা মাসের পর মাস শুনানির অপেক্ষায় পড়ে থাকে। কখনও নথি পাওয়া যায় না, আদেশের কপি পেতে সপ্তাহ-মাস কেটে যায়, অথবা প্রতিটি পদক্ষেপে বিচারপ্রার্থীকে অযথা হয়রানির শিকার হতে হয়। বিচারপ্রার্থী ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে ‘তদবির’ নামক দুর্নীতি অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত হয়েও উঠেছে। বিচারপ্রার্থীরাও অবগত তদবির না করলে মামলার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। আদালত ব্যবস্থাপনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়া এমন অনৈতিক লেনদেনের কারণে খোদ রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলমও ক্ষুব্ধ। তিনি একান্ত সাক্ষাৎকারে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন এভাবে বিচার বিভাগ চলতে থাকলে রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে যাবে ( মাহবুবে আলম)। তার ওই সাক্ষাৎকারের পর মামলা সংশ্লিষ্ট তদবির বা অনৈতিক লেনদেন নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছেন। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে বিচারপ্রার্থীদের শেষ আশ্রয়স্থল হাইকোর্টে তদবির নামের দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র।

মামলা কার্যতালিকায় তুলতে হলে প্রাথমিক শুনানি ও মুলতবি শুনানির জন্য মামলা কার্যতালিকায় (কজ লিস্ট) তোলা, অথবা অন্য যে কারণেই হোক মেনশন স্লিপ (স্লিপের মাধ্যমে মামলার বিষয়বস্তু আদালতে উত্থাপন) জমা দিলেই তবে মামলাটি সংশ্লিষ্ট কোর্টের কার্যতালিকায় আসে। সেক্ষেত্রে কোনও মামলায় রুল শুনানির জন্য দেখা যায় মামলাটি কার্যতালিকায় ৫০০ নম্বরে রাখা হয়েছে। তখন ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা বা তার বেশি অংকের টাকা দিয়ে তদবির করলে মামলাটি কার্যতালিকার সিরিয়ালে সামনের দিকে নিয়ে আসা হয়।

এরপর স্বাভাবিক নিয়মে মামলার ফাইল প্রস্তুত হওয়ার কথা।কিন্তু তা হয় না, বরং সেকশনে রেকর্ড রেঞ্জারকে টাকা দিলে তারা মামলার নথিতে সিল দেন এবং তা শুনানির জন্য প্রস্তুত করে থাকেন। নতুন মামলা করতে গেলে,অনুসন্ধানে জানা যায়, নতুন মামলা করতে গেলে আইনজীবীর ফি ছাড়াও প্রথমে স্ট্যাম্প দিয়ে কোর্ট ফি এন্ট্রি করতে হয়। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ফি’র অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। এরপর মামলার নম্বর দেওয়া হয়। সেখানেও টাকা দিয়ে কাজ করাতে হবে। নম্বর পাওয়ার পর নথিটি এফিডেভিট কমিশনারের কাছে যায়।

সেখানে তদবির করতে হয়। এ পর্যায়ে এফিডেভিট কমিশনার মামলার ডিপোনেন্টকে (হলফকারী) খোঁজেন। আগে ডিপোনেন্টকে আসতে হতো না, এখন আসতে হয়। তাই আগে এফিডেভিট কমিশনারকে ৫০-১০০ টাকা দিয়ে কাজ করানো গেলেও এখন ৩০০-৩৫০ টাকার নিচে কাজ হয় না। আবার এফিডেভিট কমিশনারের কাছে কোনও কারণে ডিপোনেন্ট না আসলে, মামলা প্রতি তাকে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। না দিলে দীর্ঘদিনেও কাজটি সম্পন্ন হবে না। মামলার আদেশ হওয়ার পর,কোনও মামলায় কোর্ট কোনও আদেশ দেওয়ার পর বেঞ্চ অফিসার (বিও)তা টাইপ করেন। কিন্তু, তদবির ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আদালতের আদেশ টাইপ হয় না এবং সিরিয়াল অনুযায়ী ফাইলও নামে না।

তাই আদেশের বিষয়ে সবসময়ই বিও’র সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়। এরপর টাইপ হয়ে আদেশটি জমাদারের কাছে যায়।আদেশটি জমাদারের মাধ্যমে বিচারপতির কাছে গেলে তারা স্বাক্ষর করেন। স্বাক্ষর শেষে আদেশটি বেঞ্চ অফিসারের কাছে আসে এবং কোর্টের পিয়ন সেই আদেশনামার জন্য ২০০-৩০০ টাকা বকশিস দাবি করে থাকেন,যেন এটা তার প্রাপ্য। আবার সেকশনে যাওয়ার পর স্বাক্ষরিত আদেশটি একজন কর্মকর্তা টাইপ করেন এবং তার সঙ্গে থেকে আরেকজন তা মিলিয়ে দেখেন।এখানে মামলাটির ফাইল একাধিক টেবিল ঘুরে ডেসপাস সেকশনে যায়।

সেক্ষেত্রে একটি টেবিল থেকে আরেকটি টেবিলে মামলার ফাইল স্থানান্তর করতেও বিচারপ্রার্থীকে তদবির নামের অনৈতিক লেনদেনে জড়াতে হয়। সবশেষে ডেসপাস সেকশনে টাকা দিলেই তবে মামলার আদেশের কপি সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানো হয়। অন্যথায় আদেশটি নড়েচড়ে না, পড়েই থাকে।আসামির জামিনাদেশের ক্ষেত্রে,কোনও আসামির জামিনের আদেশ হওয়ার পর তদবির ছাড়া কখনোই মামলার নথি সংশ্লিষ্টদের হাতে যায় না।

তাই কারও জামিনের আদেশ হওয়ার পরও যদি তদবির করা না হয়, তাহলে বছরের পর বছর মামলার ফাইল আদালতেই পড়ে থাকে, জামিনের আদেশটি আর সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানো হয় না।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আইনজীবী বলেন,কোনও মামলায় আদেশের পর বিচারপ্রার্থী বা তার আইনজীবীরা যদি সংশ্লিষ্ট কোর্টের সেকশন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অর্থ ব্যয় বা,তদবির, না করেন, তবে ফাইলটি যেভাবে আছে ঠিক সেভাবেই থেকে যায়। বছরের পর বছর কেটে গেলেও তদবির ব্যতীত মামলার আদেশ বিচারপ্রার্থীদের কাছে যায় না।

অভিযোগ রয়েছে,এমনকি হাইকোর্ট কাউকে জামিনাদেশ অথবা খালাসের আদেশ দিলেও প্রয়োজনীয়,তদবির, না করলে বিচারপ্রার্থীকে দিনের পর দিন কারাগারেই থাকতে হবে। দেখা গেছে,অভাবগ্রস্ত গরিব-অসহায় বিচারপ্রার্থীদেরকেই এ ধরনের বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয়,যার অসংখ্য নজির আগে দেখা গেছে। কয়েকজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,আইনজীবীদের সঙ্গে হাইকোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে একটি মামলায় কত টাকা পর্যন্ত তদবির করতে হবে। আবার মামলার ধরন বুঝেও এই লেনদেন বেশি-কম হয়ে থাকে।

তবে অন্ততপক্ষে একটি রিট মামলা শুধু ফাইল করতে গেলেই ১২০০ টাকা, জামিনের আদেশের কপি পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন টেবিল ঘুরে সর্বনিম্ন দুই হাজার টাকা এবং অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রে শুনানি থেকে শুরু করে আদেশের কপি হাতে পাওয়া পর্যন্ত কমপক্ষে চার হাজার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা তদবিরে খরচ করতে হয়।সুপ্রিম কোর্টের এক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, তদবিরের নামে এসব টাকা এখন আর সামনাসামনি নেওয়া হয় না।

কারণ, সেকশন অফিসগুলোতে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। ফলে ক্যামেরা নেই এমন জায়গায়,টয়লেটের ভেতরে বা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিকাশ নম্বরে এই অবৈধ অর্থের লেনদেন হয়ে থাকে।তদবির, ছাড়া মামলা না হওয়ায় ক্ষুব্ধ কয়েকজন আইনজীবী মনে করেন, হাইকোর্ট রুলসে স্পষ্ট কোনও বিধান নেই যে,হাইকোর্টে আদেশ হওয়ার কত দিনের মধ্যে মামলার আদেশ হস্তান্তর করতে হবে। রুলসে বলা হয়েছে,যত দ্রুত সম্ভব সেই আদেশ (সংশ্লিষ্টদের কাছে)পাঠানোর।

তবে আদেশ পাঠানোর বিষয়ে রুলসে নির্দিষ্ট বিধান সংযুক্ত হলে দুর্নীতি কমে আসবে বলে মনে করেন তারা।এই আইনজীবীরা আরও জানান,কোর্টের শতভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী যে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে,তা কিন্তু নয়। এখনও কিছু কিছু কোর্টের ব্যবস্থাপনা ভালো থাকায়,সেসব কোর্টের আদেশ কয়েকদিন বা কয়েক মাসের ব্যবধানে হলেও তদবির ছাড়াই পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। আবার কিছু কিছু বেঞ্চের কোর্ট ব্যবস্থাপনা ভালো হওয়া সত্ত্বেও তদবির না করলে পাঁচ অথবা সাত দিনের আগে আদেশ হাতে পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

ফৌজদারি মামলায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাইকোর্টে জামিন নিতে আসা কয়েকজন বিচারপ্রার্থী অভিযোগ করেন উকিলকে মামলা পরিচালনা করতে টাকা দিতে হয়। এছাড়াও তদবিরের কথা বলে তারা (আইনজীবী) আরও টাকা চান। অনেক আইনজীবী আবার তদবিরের পরিমাণসহ মামলা প্রতি টাকা নেন। আর আমরা হাইকোর্টের মতো জায়গা থেকে ন্যায়বিচার চাইতে এসে নিঃস্ব হয়ে যাই।এদিকে, হাইকোর্টের দুর্নীতি ও অবৈধ লেনদেনের বিষয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে গত ৫ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সহসভাপতি ও তৎকালীন কোর্ট ব্যবস্থাপনা সাব কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট ড. মো. গোলাম রহমান ভূঁইয়া।

কোর্ট ব্যবস্থাপনা সাব কমিটির প্রতিবেদনে হাইকোর্টে দুর্নীতির বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে,বর্তমানে ভালো কোর্ট (ব্যবস্থাপনা) নেই। প্রতিনিয়ত জুনিয়ররা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। মামলার নথি সেকশন থেকে আনতে গেলে বলে তদবির করেছেন,তদবির, মানে টাকা। বিও এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির স্টাফরা এত টাকার মালিক কীভাবে হয়।তাই ওই প্রতিবেদনে হাইকোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের বিবরণী প্রধান বিচারপতির কাছে দাখিল করার সুপারিশও করা হয়েছে।তিনি বলেন, কোর্টে দীর্ঘদিন ধরে একটি চিহ্নিত সমস্যা কাজ করছে। আর তা হলো কোর্টে এফিডেভিট করা থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে কোনও কাজই অনৈতিক লেনদেন ছাড়া করা সম্ভব হচ্ছে না।

একজন আইনজীবী যখন মামলা করেন, তখন আদালতে মেনশন স্লিপ দেওয়া, এরপর শুনানির জন্য কার্যতালিকায় মামলা তোলা, মামলার আদেশ বা রায় হলে ফাইল আনতে সেকশনে যাওয়া,এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই তদবির করতে হয়। অর্থাৎ কোর্টের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ঢুকে আছে। মামলার সংখ্যাও এত বেশি যে, ফাইলগুলো কোর্ট সেকশনের ফ্লোরে পড়ে থাকে। আবার ফাইল খুঁজে পাওয়া যায় না।

ফাইল পেতে রেকর্ড কিপারের কাছে যেতে হয়। টাকা দিয়ে খুঁজতে না বললে ফাইল খোঁজে না। মামলা কার্যতালিকায় থাকলেও দেখা যায় ফাইল পাওয়া যাচ্ছে না।তিনি আরও বলেন, আমরা এসব দুর্নীতির বিষয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে প্রতিবেদন দিয়েছি। তিনি প্রতিবেদনটি দেখে ধাপে ধাপে পদক্ষেপ নেবেন বলে জানিয়েছেন। আশা করছি, প্রধান বিচারপতি বিষয়টি দেখবেন।বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন,দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য বিচারপতিরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কোর্টের বেঞ্চ অফিসার, এমনকি পিয়নদের বাড়িতে পর্যন্ত লেনদেন হয়।

মূলত এদের (কোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের) মধ্যে দেশপ্রেম নেই। যদি দেশপ্রেম থাকতো তাহলে দেশের জন্য কাজ করতো। আর যেহেতু দেশপ্রেম নেই তাই তারা চিন্তা করে, কীভাবে টাকা লুটপাট করা যায়। এই পচন একদিনে ধরেনি। ধীরে ধীরে এই পচনের সৃষ্টি হয়েছে। তাই দেশপ্রেম ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত এ দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব হবে না।তদবিরের বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল ড. মো. জাকির হোসেন বলেন, আমরা সবসময়ই কোর্টের কিছু না কিছু সেকশন তদারকি করছি। এসময় কর্মকর্তাদের বিভিন্ন উপদেশ দিচ্ছি। মানুষ যেন দ্রুত সেবা পায়, সে বিষয়ে তাদের সতর্ক করছি।

এছাড়া, অভিযোগ প্রমাণিত হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি বা বহিষ্কারও করা হচ্ছে। প্রধান বিচারপতি (সৈয়দ মাহমুদ হোসেন) আসার পর এবং আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেকের (কর্মকর্তা-কর্মচারীর) বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ নিষ্পত্তি করেছি। প্রতি মাসে অন্তত ২১টি অভিযোগের নিষ্পত্তি হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি। তবে এখানে সবাইকেই সহযোগিতা করতে হবে।

আইনজীবীদের সহযোগিতা পেলে দুর্নীতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। সেজন্য আমাদের কাছে নির্দিষ্ট করে অভিযোগ দিতে হবে। অভিযোগ পেলেই আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।সুত্র:বাংলা ট্রিবিউন

এখানে কমেন্ট করুন: