নরসিংদীতে একক প্রভাব খাটিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের আওয়ামী লীগে পুনর্বাসন করে চলেছেন সদর আসনের এমপি নজরুল ইসলাম হীরু। এমনকি নরসিংদীর জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হোসেনের সমর্থকদের সহযোগিতায় একলাফে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে আসীন হওয়া এই নেতা এখন লোকমান হত্যা মামলার আসামিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন। এমপির এমন কর্মকান্ডে বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগে চরম ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।

এমপির নেতৃত্বে জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক এখন হয়ে গেছে শহর আওয়ামী লীগের সদস্য। শহর যুবদলের সহসভাপতি বসে গেছেন যুবলীগ সভাপতি পদে। ওয়ার্ড যুবদলের সাধারণ সম্পাদক হয়ে গেছেন সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি।

মেয়র লোকমান হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি আশরাফুল সরকার। আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছিলেন তিনি। একই মামলার চার্জশিটভুক্ত আরেক আসামি হলেন মোবারক হোসেন মোবা। এই দুজনসহ জেলার বেশির ভাগ সন্ত্রাসী এমপি হীরুর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এখন জেলাজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এমপির প্রধান সেনাপতির দায়িত্বে থাকা রিপন সরকারও পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। নরসিংদী পৌরসভার এই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক, খুনসহ বিভিন্ন অপরাধে একাধিক মামলা রয়েছে।

জানা যায়, এমপি হীরুর আপন ভাগ্নে নাজমুল করিম পিন্টু ছিলেন জেলা ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। সেই পিন্টু এখন নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সদস্য। আর পিন্টুর মাধ্যমে সংসদীয় এলাকার সব উন্নয়ন প্রকল্পের একচেটিয়া সুবিধা নিচ্ছেন বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা। এমপির ভাতিজা দিদারুল হক ভূঞা বিপ্লব ছিলেন নরসিংদী শহর যুবদলের সহসভাপতি। তাঁর বিরুদ্ধে জোট সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের অভিযোগ আছে। এমপি প্রভাব খাটিয়ে সেই বিপ্লবকে শহর যুবলীগের সভাপতি পদে বসিয়েছেন। আর পদ পেয়েই সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন বিপ্লব। ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনা নিয়ে বিপ্লবের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলনও হয়েছে।

মাধবদী পৌর এলাকার ৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মনির হোসেন ভুঁইয়া ওরফে নাতি মনির। এমপি হীরুর দূর সম্পর্কের ভাগ্নের ছেলে এই মনির এখন সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি। পদটির প্রার্থী ছিলেন সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুগ্ম সম্পাদক শ্রীকান্ত দাস মানিক। অভিযোগ রয়েছে, ভয় দেখিয়ে তাঁকে প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখেন এমপি হীরু।

শ্রীকান্ত দাস মানিক বলেন, ‘আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতে গিয়ে বহু হামলা-মামলার শিকার হয়েছি। কিন্তু দলের পদ-পদবি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে পিছিয়ে গেছি। যাদের ক্ষমতা আছে, যারা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল, তারাই বড় পদ বাগিয়ে নিয়েছে।’

জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান শামীম নেওয়াজ বলেন, নরসিংদীতে বিএনপি-জামায়াতের আশ্রয়দাতা এমপি নজরুল ইসলাম হীরু। একসময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালানো বিএনপির নেতাদের তিনি আওয়ামী লীগে বড় বড় পদ-পদবি দিচ্ছেন। তিনি মেয়র লোকমানের খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন, মঞ্চে নিয়ে সভা-সমাবেশ করছেন।

সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবু দাউদ বলেন, ‘১৩ বছর সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম; বাবা উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা। আমি জেলা পরিষদের সদস্য পদে নির্বাচন করতে মনোনয়ন ফরম কিনেছিলাম; কিন্তু এমপি হীরু আমাকে ও বাবাকে ডেকে নিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে আমাকে বলেন, ‘আমার নাতি মনির হোসেন জেলা পরিষদের নির্বাচন করবে। তুমি প্রত্যাহার করে নিবা, নইলে কিন্তু বাড়িতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারবা না।’ নিরুপায় হয়ে আমি সরে দাঁড়ালে মনিরকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেলা পরিষদ সদস্য নির্বাচিত করা হয়।’

জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত নরসিংদীর গাবতলী এলাকা। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে নজরুল ইসলাম হীরুকে এখানে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় জামেয়া কাসেমিয়া দারুল উলুম মাদরাসার অধ্যক্ষ ও জেলা জামায়াতের সাবেক আমির কামাল উদ্দিন জাফরি। এই কামাল উদ্দিন জাফরি একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বেয়াই।

অভিযোগ রয়েছে, জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়া ও মফিজুল হক চৌধুরী সুমন দম্পতি এমপি হীরুর আশ্রয়-প্রশ্রয়েই নরসিংদীতে গড়ে তোলেন কেএমসি বাহিনী। বিনিময়ে এমপির দলীয় সব কর্মসূচিতে এই দম্পতি লোকবল হাজির করে দিতেন।

নরসিংদী পৌরসভার বর্তমান মেয়র প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনের ছোট ভাই কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমার ভাইয়ের খুনিদের পাশে বসিয়ে এমপি হীরু মঞ্চে বক্তৃতা করে বেড়ান। এটা নরসিংদীবাসী মেনে নিতে পারে না। কেন্দ্র থেকে নিরপেক্ষ তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে যে স্থানীয় এমপি কিভাবে জেলায় বিএনপি-জামায়াতকে পুনর্বাসন করে চলেছেন।’

জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বলেন, এমপি হীরুর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম পদটিই জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এর আগে তিনি আওয়ামী লীগের কোনো পদেই ছিলেন না। প্রয়াত মেয়র লোকমানের সমর্থকদের সহযোগিতায় তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি হলেও এখন সেই লোকমান হত্যা মামলার আসামিদের নিয়েই তিনি সভা-সমাবেশ করছেন।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মতিন ভূইয়া বলেন, ‘লোকমান হোসেনের খুনিদের মঞ্চে পাশে বসিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও এমপি হীরু বক্তৃতা করেন। নরসিংদীবাসী এটা মেনে নিতে পারে না। এমপি হীরু আওয়ামী লীগের স্বার্থ না দেখে বিএনপি-জামায়াতের স্বার্থ রক্ষায় মরিয়া।’

মেয়র লোকমান হত্যা মামলার আসামিকে মঞ্চে তোলা প্রসঙ্গে সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম হীরু বলেন, ‘এ রকম আসামি আমার মঞ্চে উঠেছে কি না আমি জানি না। তবে কেউ জামিন পেয়ে আমার মঞ্চে উঠে থাকলে সেটা তো দোষের কিছু না। আদালত বিষয়টি দেখবে।’

জেলায় আওয়ামী লীগ ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনে বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে পদ দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী কারা সংগঠনে এসেছে তা আমি ভালো বলতে পারছি না। আর যদি এসেও থাকে তাহলে তা শুধু আমার জেলায়ই নয়, সারা দেশেই এমন ঘটছে। একটা সরকার পরিবর্তন হলে অন্য দলের নেতাকর্মীরা ক্ষমতাসীন দলে যোগ দেয়। এটি কোনো বিষয় নয়।’

(সূত্র: কালের কণ্ঠ)

এখানে কমেন্ট করুন: