মো.শফিকুল ইসলাম(মতি)নরসিংদী :নরসিংদী সদর হাসপাতালে দালাল চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে রোগীরা। চিকিৎসক তথা পরিচালকরাও অনেক ক্ষেত্রে দালালদের প্রশ্রয় দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। দালাল চক্র থেকে সতর্ক থাকার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আহ্বানের পর নরসিংদী সদর হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে আগের অবস্থায়ই গ্রাম থেকে আসা অধিকাংশ রোগী দালাল ছাড়া চিকিৎসকদের সাথে কথা বলতে পারছে না। যারা দালালের সহযোগিতা নেননি তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলেও পেছন থেকে অথবা লাইনে না দাঁড়িয়েও দালালের সাথে ভেতরে ডাক্তারের চেম্বারে চলে যাচ্ছে অনেকে। রাত সাড়ে ১০টা কি তার একটু বেশি হবে। নরসিংদী সদর হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগের সামনে মধ্য বয়সী একজন আর্তনাদ করে কাঁদছে আর মাঝে মধ্যে চেঁচিয়ে উঠে বলছে এখন কই গেলি শালারা। কুত্তার বাচ্চারা, আমার মরা পোলারে লইয়্যা তোরা দালালি করতে চাইচোত। অহন সামনে আয়, সবডি পলাইছত কে? পারলে অহন সামনে আয়। ওই লোকটার বকাঝকার কারণ জানতে এগিয়ে যায় গণমাধ্যমকর্মীরা।কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই লোকটি বলেন, আমার ছেলে কিছুক্ষণ আগে মোটরসাইকেল এক্সিডেন্টে মারা গেছে। হাসপাতালে আনার পর ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করার পরও ইমার্জেন্সির লোকজন বলে একটি এক্সরে ও একটা ইসিজি করে দেখতে। আর তখনই কয়েকজন দালাল লাশের উপর হামলে পড়ে। আমার মরা ছেলের লাশ নিয়ে টানাহেঁছড়া শুরু করে দেয়।

অমুক ক্লিনিকের ইসিজি খুব ভালো হয়, খরচও কম নেয়। এইসব আরকি। ডাক্তার যখন সাফ জানিয়ে দেন কিছু করা লাগবে না আর আমাদের লোকজনও যখন একটু গরম হয়ে যায় তখন সবগুলান ভাগছে। শুক্রবার (২৩ এপ্রিল) কথাগুলো বলছিলেন নরসিংদী সদর উপজেলার নজরপুর ইউনিয়নের শেখ হাসিনা সেতু সংলগ্ন কালাইগোবিন্দপুর এলাকায় মোটরসাইকেল দুর্গটনায় নিহত আরিফের পিতা রফিকুল ইসলাম।নরসিংদী সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে দালালদের টানাহেঁচড়া নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ হাসপাতালে প্রতিদিনই এমন দৃশ্য নজরে পড়ে। দালালদের দৌরাত্ম্যের কারণে নরসিংদী সদর হাসপাতালের রোগীরা তাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। রোগী ও তাদের আত্বীয়-স্বজন এখানে রোগী নিয়ে এসে দালালদের কাছে অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়, দালাল ছাড়া এখানে কোনো চিকিৎসাসেবা মিলে না। হাসপাতালের সব জায়গায় এদের অবাধ বিচরণ। হাসপাতালের গেট, জরুরি বিভাগ, অপারেশন থিয়েটার, আউটডোর কোথায় নেই এরা?সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নরসিংদী সদর হাসপাতালে তিন শ্রেণির দালালচক্র কাজ করে। একটি চক্র হাসপাতালে রোগী এলেই হামলে পড়ে। তাদের কাজই হচ্ছে রোগী বাগিয়ে ভালো চিকিৎসার নাম করে বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয় চক্রটি হাসপাতালের বহিঃবিভাগে বিভিন্ন ডাক্তারদের কক্ষের বাইরে অবস্থান নেয়। রোগীরা ডাক্তারের কক্ষ থেকে বের হয়ে আসার পর তাদের হাত থেকে প্রেসক্রিপশন ছিনিয়ে নিয়ে দেখে কি কি পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেওয়া হয়েছে। রোগী ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কম খরচে ওই পরীক্ষাগুলো করিয়ে দেবেন বলে ফুসলিয়ে নিয়ে যান অন্যত্র।

অথচ ওই পরীক্ষাগুলোই নামমাত্র খরচে সদর হাসপাতাল থেকে করা যায়।আর তৃতীয় চক্রটি অবস্থান নেয় জরুরি বিভাগ ও আন্তঃবিভাগে। তারা মূলত হাসপাতালের বাহিরের বিভিন্ন ওষুধের দোকানের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। কোনো রোগীর ওষুধ প্রয়োজন হলে তারাই দৌড়ে গিয়ে এনে দেন। টাকার কথা বললে বলা হয় দিয়েন এক সাথে। এখনতো আর চইল্যা যাইতাছেন না।রোগী বা তাদের আত্মীয়-স্বজন বাকিতে ওষুধ পাওয়ার সুবিধা ভোগ করতে পেরে চুপ থাকেন।এই সকল দালালচক্র বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক বা স্থানীয় কোনো না কোনো প্রাইভেট ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ফার্মেসির কমিশন এজেন্ট হিসেবে কাজ করে।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নরসিংদী সদর হাসপাতালের চারপাশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এসব প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর মালিকানার ক্ষেত্রে হাসপাতালের কোনো না কোনো ডাক্তার-নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত রয়েছেন। তারাই ওই দালালদের নিয়োগ করেন। তাদের মদদে দালালরা হয়ে উঠেছে আরও বেশি বেপরোয়া। হাসপাতালে ভর্তিসহ চিকিৎসা করাতে হয় তাদের মাধ্যমেই। যেকোনো অপারেশনের ক্ষেত্রেও রোগী বা তার আত্মীয়-স্বজনদের চুক্তিবদ্ধ হতে হয় দালালদের সঙ্গে। অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে এরা। অপারেশনের সময় প্রয়োজনীয় ওষুধও দালালদের পছন্দের দোকান থেকে বেশি দামে কিনতে হয়।দূর-দূরান্ত থেকে আসা অসহায় রোগীরাই মূলত তাদের শিকারে পরিণত হয়। সংঘবদ্ধ দালালদের বিরুদ্ধে অনেকেই প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। অধিকাংশ দালাল হাসপাতালের বিভিন্ন পদে কর্মরত, আর অন্যরা কর্মচারী না হয়েও কাজ করে কর্মচারীর মতো। কাজ শেষে তারা টাকা দাবি করে। তাছাড়া কোনো জখমি হাসপাতালে ভর্তি হলে দালাল ছাড়া সার্টিফিকেট প্রদান হয়না বলেও অভিযোগ রয়েছে।বর্তমানে পুরুষ দালালের চেয়ে নারী দালালের সংখ্যা বেড়েছে। এই সকল দালালরা কোনো না কোনো রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় থেকে তাদের কাজ করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালের চারপাশে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা এ সকল প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো যেকোনো পরীক্ষার ক্ষেত্রে যে ডাক্তার প্রেসক্রাইভ করেছে তাকে শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ কমিশন দিয়ে থাকে। তাই ডাক্তাররা উপরি কামাই হিসেবে রোগী দেখার সময় যে পরীক্ষাগুলো দেন তা বাইরে থেকে করিয়ে আনার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

তারা ঘুর্নাক্ষরেও বলে না- এই পরীক্ষাগুলো স্বল্প খরচে এই হাসপাতাল থেকে করানো সম্ভব।শুধু হাসপাতালের আন্তঃবিভাগ কিংবা বহিঃবিভাগ নয়, হাসপাতাল মর্গেও এদের দৌরাত্ম দেখা যায়। মর্গে কোনো লাশ আসলে তা কাটা-ছেঁড়ার জন্য লাশের স্বজনদের কাছে এরা মোটা অংকের টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে লাশ ছুঁয়েও দেখে না মর্গের ডুম। এদিকে সিভিল সার্জন কার্যালয় মাঝে মধ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করলেও এই দালালচক্র থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কারণ, আগ থেকেই এই খবর তাদের কাছে পৌঁছে যায়।দালালদের দৌরাত্ম্যের বিষয়ে জানতে চাইলে নরসিংদী সিভিল সার্জন ডা. নুরুল ইসলাম বলেন, সব হাসপাতালেই কমবেশি দালাল রয়েছে। তবে সদর হাসপাতাল থেকে দালাল নির্মূলে আমরা পুলিশ সুপার, জেলা প্রশাসন, মডেল থানাসহ প্রশাসনের সহযোগিতায় দালালদের ধরে লাঠিপেটা করে আইনের আওতায় এনেছি। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই তারা আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। দালাল নির্মূলে বিগত সময়ের ন্যায় তাদের কার্যক্রম অব্যাহত আছে বলেও জানান তিনি।নরসিংদী সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. শামিম দালালদের দৌরাত্ম্যের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় দালালরা তাদের এ সকল অনাকাঙিক্ষত ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। আমাদের একপাশে বেপারীপাড়া অন্য পাশে কাউরিয়া পাড়া, এ দুই এলাকার মানুষের মদদেই দালালরা সর্বদা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। অধিকাংশ দালালই এখানের স্থানীয় বাসিন্দা, তাই তাদের বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়না। ইতোপূর্বে একাধিকবার তাদের আইনের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে, কিন্তু জামিনে মুক্তি পেয়ে পুনরায় তারা স্ব-স্থানে ফিরে আসে।তাই সদর হাসপাতালের দালাল নির্মূলে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি

এখানে কমেন্ট করুন: