নরসিংদী জেলার সাব-রেজিস্ট্রার, নকল নবীশ, উম্মেদার, এক্সট্রা মোহরার, বালামকারক, পিয়ন ও দালালের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ভুক্তভোগীরা। একটি চক্র সংঘবদ্ধ ভাবে নরসিংদী সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ভুক্তভোগীদের জিম্মি করে ঘুষ বাণিজ্য, দুর্নীতি-অনিয়ম ও হয়রানি চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। ঘুষ গ্রহণ করে জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে শত শত একর জমি, প্লট-ফ্লাট সম্পূর্ন অবৈধ ও বেআইনীভাবে রেজিস্ট্রি করে দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক হচ্ছেন তারা। তাদের এসব অবৈধ কর্মকান্ড ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ ও স্থানীয় নেতা-কর্মী, পুলিশসহ নাম সর্বস্ব পত্রিকার সাংবাদিকদের হাত করে রেখেছেন সাব রেজিস্ট্রাররা। এদিকে বাংলাদেশ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন ম্যানুয়াল-২০১৪ এর নিয়ম মানছেন না সাব-রেজিস্ট্রাররাও। এই বিষয়ে গণমাধ্যমে পূর্বে রিপোর্ট প্রকাশিত হলেও কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, নরসিংদী সদর সাব-রেজিস্ট্রার ও একই অফিসের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যোগসাজসে কাগজপত্র জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে অবৈধভাবে বিভিন্ন দলিল রেজিস্ট্রি করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এছাড়াও এই অফিসে নরসিংদীস্থ বিভিন্ন এলাকার জমি রেজিস্ট্রিতে জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই বিষয়ে নরসিংদী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের এক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেন।
সরেজমিনে গতকাল সোমবার দুপুর ১১টা ১০ মিনিটে দেখা গেছে, নরসিংদী সদর সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসের চারপাশে শুধু দালাল আর দালাল। এসব দালালরা সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে আসা উপকারভোগীদের সাথে নানা ছলে বলে কৌশলে কথা বলে তাদেরকে একসময় জিম্মি করে ফেলে। জানা গেছে, এসব দালালদের সাথে সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। অপরদিকে, সাব-রেজিষ্ট্রি কর্মকর্তাদেরকে জমি ক্রয় ও বিক্রয়কারীকে খাস কামড়ায় নিয়ে কক্ষের দরজা বন্ধ করে গোপনে কথা বলতে দেখা যায়। এছাড়াও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নিয়ে মুল কপি না দেখে দলিল রেজিস্ট্রি করার অভিযোগ ও পাওয়া গেছে। এসব বিষয়ে নরসিংদী সদর সাব-রেজিস্ট্রারের সাথে সরাসরি কথা বলে জানা যায়, তিনি কুচক্রী মহলের ভয়ে এসব কাজ করে যাচ্ছেন, তার কিছুই করার নেই। এমনকি তিনি নরসিংদী সদর সাব-রেজিষ্ট্রি থেকে স্থানান্তরিত হওয়ার চেষ্টাও করছেন বলে জানা যায়।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন ম্যানুয়াল-২০১৪ এর অধ্যায়-২৬ এ উল্লেখ আছে যে, “সহকারীগণ কর্তৃক দলিল পরীক্ষাকরণ কাঙ্খিত নহে, এই কার্যটি অবশ্যই স্বয়ং নিবন্ধনকারী কর্মকর্তা কর্তৃক সম্পাদিত হইবে।”
এরপরও সাব-রেজিষ্ট্রার নিবন্ধন ম্যানুয়াল অনুযায়ী নিজেদের কাজ নকল নবিশ, উম্মেদার ও পিওনদের দিয়ে এ কাজ করাচ্ছেন। দলিল চেক করার কাজ সাব-রেজিষ্ট্রারের করার নিয়ম থাকলেও তা মানছেন না তারা। গতকাল সরেজমিনে গিয়েও নকল নবীশ ও উম্মেদারদের এসব কাজ করতে দেখা গেছে। গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দুপুর ১১ টা ৫৫ মিনিটে দেখা গেছে, নরসিংদী সদর সাব-রেজিষ্ট্রার অফিসের নকল নবিশ রেজিস্ট্রি দলিল চেক করছেন। এরপরই কথা বলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি বলেন, এ বিষয়ে আপনার সাথে পরে বোঝাপড়া হবে। একই ভাবে অন্যান্য কর্মচারীদেরকেও দলিল চেক করতে দেখা গেছে।
নরসিংদী সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে ক্ষমতার প্রভাব চালিয়ে একদল কুচক্রী মহলের নিয়ন্ত্রণে এসব অবৈধ কাজ দীর্ঘদিন যাবৎ চলে আসছে। সাব-রেজিষ্ট্রার অফিস জিম্মি করে এসব অবৈধ কাজ করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। নরসিংদী সদর সাব-রেজিষ্ট্রার অফিসে সেবা নিতে গিয়ে হয়রানি বা দুর্নীতির শিকার হয়েছেন এমন ব্যক্তিরা অভিযোগও করেছেন। নরসিংদী সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের মুল গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে টেবিল চেয়ার নিয়ে সারি সারি বসে আছেন দলিল লেখক হিসেবে পরিচয় বহনকারী কিছু মানুষ। এই বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি। বছর দেড়েক আগে তিনি তার জমির দলিল হারিয়ে ফেলেন। দলিল হারানোর পর এখন পর্যন্ত তিনি কয়েক দফা বিভিন্ন জায়গায় টাকা দিয়েছেন। তবে এখনো পর্যন্ত এর কোন সুরাহা হয়নি। একইভাবে অপর এক ব্যক্তি তথ্য হালনাগাদ করতে এসে দুই বার এই অফিসে তাকে ঘুষ দিতে হয়েছে বলে জানান।