নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলায় বাবা হত্যার প্রতিশোধ নিতে ঘরের বাইরে থেকে তালা মেরে ঘরের ভেতরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
‘তারা আমাদের বাবাকে মেরে ফেলেছে। তারা এলাকায় আসবে কেন ? এলাকায় আসলে তাদের মেরে ফেলব। বাবা হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই আমরা সেই ঘরে আগুন দিয়েছি।’ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে এমন তথ্যই দিয়েছে গ্রেপ্তার হওয়া দুজন।
এরই মধ্যে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন আসামি মাহমুদুল হাসান রবিন (২৬) ও মামুন মিয়া (১৯)।
এদিকে একই পরিবারের চারজনকে আগুনে দগ্ধের ঘটনায় ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। বুধবার দুপুরে রায়পুরা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সাতজনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা আরো চারজনসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন পরিবারের রত্না আক্তার। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রায়পুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহসিনুল কবির।
আসামিরা হলেন মৃত দুলাল গাজীর দুই ছেলে মাহমুদুল হাসান রবিন (২৬) ও সুবন মিয়া (২০), মৃত ফজলু মিয়ার ছেলে শিপন মিয়া (৩৫), মৃত সোহরাব মিয়ার ছেলে মামুন মিয়া (১৯), মৃত মান্নান মিয়ার ছেলে কাজল মিয়া (৪০), মৃত ইদ্রিস মিয়ার ছেলে আল-আমিন (২৮) ও মোসলেহ উদ্দিনের ছেলে লোকমান হোসেন (২০)। তাঁদের সবার বাড়ি উপজেলার উত্তর বাখরনগর ইউনিয়নের লোচনপুর গ্রামে।
এদের মধ্যে মাহমুদুল হাসান রবিন ও মামুন মিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁরা ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করে অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম শামীমা আক্তারের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
রায়পুরা থানার দ্বিতীয় কর্মকর্তা দেব দুলাল দে জানিয়েছেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আসামিদের সঙ্গে দগ্ধ নারীদের পরিবারের বিরোধ চলে আসছিল। এরই জের ধরে মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৫টায় তাঁদের ঘরে কেরোসিন ও পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেন আসামিরা। ওই সময় তাঁরা ঘরের কলাপসিবল গেইটে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেন।
আগুনে দগ্ধ হয়ে তাঁদের ঘুম ভেঙে যায়। ওই সময় তাঁদের আত্মচিৎকারে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। পরে তাঁরা স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় বাড়ির একটি ভাঙা জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন।
অগ্নিদগ্ধরা হলো উপজেলার লোচনপুর গ্রামের মৃত সামসুল মিয়ার মেয়ে প্রীতি (১১), সুইটি (১৩) ও মুক্তামণি (১৬) এবং তাদের ফুফু খাতুন নেছা (৬৫)।
দগ্ধ তিন বোনের মধ্যে মুক্তামণি এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। সুইটি স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে এবং প্রীতি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। এদের মধ্যে মুক্তামণির শরীরের ১০ শতাংশ, সুইটির ১৫ শতাংশ, প্রীতির ১৫ শতাংশ এবং খাতুন নেছার শরীরের ১২ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। তাঁদের প্রত্যেকেরই কমবেশি শ্বাসনালি পুড়েছে।
লোচনপুর গ্রামে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, একতলা ভবনের চারটি রুমেই জানালার কাচ ভেঙে পড়ে আছে। অন্য একটি রুমে জাজিম ও তোষক আগুনে পোড়া অবস্থায় পড়ে আছে। এবং সে রুমের পেছনের জানালার গ্রিলটিও ভাঙা। তবে প্রবেশদারের মূল কলাপসিবল গেটটি খোলা অবস্থায় ছিল। প্রতিপক্ষ শত্রুরা ওই ভাঙা জানালা দিয়েই পেট্রল ও কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়েছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। রুমে কোনো আসবাবপত্র ছিল না।
প্রতিপক্ষরা গত ৬ ফেব্রুয়ারি এই বাড়িটিতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করে আগুন লাগিয়ে দেয়। এর পর থেকেই বাড়িটি জীর্ণ অবস্থায় পড়ে ছিল। গত সোমবার ফুফুকে নিয়ে তিন বোন বাড়িতে রাত্রিযাপন করে। এদিন ভোর রাতে শত্রুরা পুনরায় আগুন লাগিয়ে দেয়।
পুলিশের সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গত ৬ ফেব্রুয়ারি উত্তর বাখরনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি গাজী আবদুল মান্নানের ছেলে শাহাদাত হোসেন ওরফে দুলাল গাজীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ বিষয়ে নিহত দুলাল গাজীর ছেলে মাহমুদুল হাসান রবিন বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। মামলার অন্যতম আসামি শামসুল হকের দুই ছেলে সোহাগ ও বিপ্লব মিয়া। এই ঘটনার পরই শামসুল হকের বাড়িতে হামলা হয়। ভেঙে ফেলা হয় বাড়ির দরজা-জানালা। তখন থেকেই বাড়ির লোকজন এলাকাছাড়া হওয়ায় বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল। আদালত থেকে কিছুদিন আগে বিপ্লব জামিনে মুক্তি পান। এরপর সোমবার বাড়িতে আসেন পরিবারটির সদস্যরা। পরের দিন ভোরে ওই বাড়িতে অগ্নিদগ্ধ হন বিপ্লব মিয়ার তিন বোন ও ফুফু।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত মাহমুদুল হাসান রবিন বলেন, ‘তারা আমাদের বাবাকে মেরে ফেলেছে। তারা এলাকায় আসবে কেন ? এলাকায় আসলে তাদের মেরে ফেলব। বাবা হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই আমরা সেই ঘরে আগুন দিয়েছি।’
ওই নারীরা কী ক্ষতি করেছে পুলিশের এমন প্রশ্নের জবাবে রবিন বলেন, এই পরিবারের সবাই আমাদের শত্রু।
একই কথা বলেন রবিনের ফুফাতো ভাই অপর আসামি মামুন মিয়া।
পুলিশ জানায়, দীর্ঘদিন ধরে দুই পরিবারের মধ্যে স্থানীয় আধিপত্য ও জমি নিয়ে বিরোধ চলে আসছে। এরই সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে যোগ হয়েছে মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ। দুলাল গাজীর ভাগ্নে মামুন মিয়া পুলিশের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী। অপরদিকে সামছুল মিয়ার ছেলে বিপ্লব মিয়ার বিরুদ্ধেও মাদক ব্যবসায় সংশ্লিষ্টতার জনশ্রুতি রয়েছে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে উভয়পক্ষের মারমুখি অবস্থানে একের পর এক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে।
মামলার বাদী রত্মা আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা আমার বোন ও ফুফুকে পেট্রল ও কেরোসিন ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে মারতে এই হামলা চালিয়েছে। অল্পের জন্য তাঁরা বেঁচে গেলেও হাসপাতালে জীবন মৃত্যুর লড়াই করছে। তারা হামলা করেই ক্ষান্ত হয়নি আমাদেরকে বাড়িঘরে যেতে দিচ্ছে না। আমরা তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।
নরসিংদী জেলার পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃত দুই আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ঘটনার রহস্য উদঘাটিত হয়েছে। মূলত জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরেই এই ঘটনা ঘটেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ঘটনায় সম্পৃক্তদের পরিচয় পেয়েছি। তাদেরকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।
এখানে কমেন্ট করুন: