কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রবিউল ইসলামের বিরুদ্ধে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) জালিয়াতি, অন্যের জমি আত্মসাৎসহ ২৫টি গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। নানা জালিয়াতি ও অবৈধ বাণিজ্যে গত তিন বছরে শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ তদন্তে তাঁকে তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে তাঁকে ২১ এপ্রিল দুদকের কুষ্টিয়া সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হলে ওইদিন তিনি হাজির হয়ে আরও সাত দিন সময় নিয়েছেন। অভিযোগে জানা যায়, এনআইডি জালিয়াতির মাধ্যমে অন্যের জমি আত্মসাতের মামলায় উঠে আসে জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রবিউল ইসলামের নাম।

ওই মামলার আসামি মহিবুল ইসলামের ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে সাবেক চেয়ারম্যানের এ সম্পৃক্ততা মেলে। জেলা প্রশাসনসূত্রে জানা গেছে, জমি জালিয়াতির ওই ঘটনাসহ সাবেক এই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে এর আগে ২৫টি অভিযোগ জমা পড়ে জেলা প্রশাসন গঠিত কমিটির কাছে। কিন্তু জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ায় গত দুই বছরেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সূত্র জানান, জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এই রবিউলের দখলদারির হাতেখড়ি কুষ্টিয়ার বিখ্যাত মোহিনী মিলের সম্পত্তি দখলের মধ্য দিয়ে।
অবিভক্ত বাংলায় ১৯০৮ সালে কুষ্টিয়া শহরে ৩৩ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত মোহিনী বস্ত্র মিলটি লোকসানে পড়ে ১৯৮২ সালে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। মিলের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে জ্বালানি সরবরাহকারী ঠিকাদাররা মিলকে লোকসানে ফেলেন। ওই ঠিকাদারদের মধ্যে রবিউল ইসলামও ছিলেন। মোহিনী মিলের তৎকালীন শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘মিলের তৎকালীন তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আবুল খায়ের, আবুল ফাত্তাহ ও আবদুর রহিমের সঙ্গে আঁতাত করে রবিউলসহ কয়েকজন ব্যবসায়ী ১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ায় শেষমেশ মিলটি বন্ধ হয়ে যায়।
রবিউল তখন মিলের জ্বালানি বাদে সব ভারী কাঁচামাল সরবরাহ করতেন। ’ রবিউল ইসলাম ১৯৮৪ সালে কুষ্টিয়া পৌরসভার কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এরপর রবিউলসহ স্থানীয় ওই চক্রটি অনিয়মের মাধ্যমে একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক বনে যান। রবিউল ইসলামের সেই উত্থান। নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও দলীয় পদপদবি কাজে লাগিয়ে শহরের মিলপাড়ায় তিনি হয়ে ওঠেন দাপুটে দখলবাজ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক অভিযোগকারী জানান, দীর্ঘদিন পৌর কাউন্সিলর থাকায় রবিউল জালিয়াতির মাধ্যমে একের পর এক সম্পত্তি দখল করেন। এমনকি ২০১৪ সালে ব্যবসায়িক অংশীদার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও এমপি খন্দকার রশিদুজ্জামান দুদুর মৃত্যুর পর মিলপাড়ায় তাঁর (দুদু) বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি জালিয়াতি করে নিজ নামে লিখে নেন রবিউল। বর্তমানে নিজের বাড়ি ভাড়া দিয়ে সেখানেই থাকছেন। ২০১৭ সালে কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে তিনি সরকারি জমি দখলের প্রতি নজর দেন।

সড়ক ও জনপথ বিভাগসূত্রে জানা গেছে, কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী সড়কে নির্মাণাধীন কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের পাশে লাহিনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রাচীর ও সড়ক ঘেঁষে সড়ক ও জনপথের প্রায় ৬ শতাংশ জমি ছিল। এ প্লটসহ জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের অন্তত ১০ বিঘা জমি দখল করেছেন রবিউল। ২০২০ সালের শেষ দিকে সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী ১০ দিনের মধ্যে প্রাচীর সরিয়ে নেওয়ার জন্য রবিউলকে নোটিসও দেন। কিন্তু অদৃশ্য কারণে সেই প্রাচীর আর ভাঙতে পারেনি সড়ক বিভাগ। সড়ক ও জনপথ কুষ্টিয়ার বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘রবিউল ইসলাম মেডিকেলের পাশে আমাদের ২০০ ফুট লম্বা, ১৩ ফুট চওড়া একটি জায়গা অবৈধভাবে দীর্ঘদিন দখলে রেখে সেখানে উঁচু দেয়াল তুলেছেন। আমরা সেটিসহ আরও বেশ কিছু দখলদার উচ্ছেদে নোটিস দিয়েছি। ’ গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের বসবাসের জন্য ১৬ একর জমিতে ২১২টি প্লট করে লটারির মাধ্যমে বরাদ্দ দেন। এর দুই বছর পর সে জমি জেলা প্রশাসক ‘রিজুম’ করে খাস খতিয়ানভুক্ত করেন। বিষয়টি জানার পর প্লট মালিকরা উচ্চ আদালতে রিট করলে আদালত ওই জমির ওপর সব কর্মকাণ্ড স্থগিত ঘোষণা করেন। এ অবস্থায় আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কোনো বরাদ্দ ছাড়াই সেই জমি দখল নিয়ে রবিউল সেখানে ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে কুষ্টিয়া জেলা পরিষদ অডিটোরিয়াম নির্মাণ করছেন। এ ব্যাপারে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ রাজশাহীর তত্ত্বাবায়ক প্রকৌশলী পরিমল কুমার কুরি বলেন, ‘রবিউল ইসলাম আমাদের অনেকখানি জায়গা দখল করে সেখানে অডিটোরিয়াম নির্মাণ করছেন, যা সম্পূর্ণ অবৈধ। এ জায়গাটি বিভিন্ন ব্যক্তির নামে বরাদ্দ দেওয়া। এ ছাড়া তিনি আমাদের আরও দেড় কাঠা জায়গা নিজে দখল করে বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে রেখেছেন। আমরা বিষয়গুলো প্রশাসনকে জানিয়েছি। কিন্তু কেউ তো তাঁর কিছুই করতে পারে না। ’ জেলা প্রশাসনসূত্রে জানা গেছে, চেয়ারম্যান থাকাকালে রবিউল ২০২১ সালে শহরের মিলপাড়ায় গড়াই নদী ভরাট করে প্রায় ৫০ বিঘা জমির ওপর জেলা পরিষদ ইকো পার্ক নির্মাণ করেন। নদী কমিশনের চেয়ারম্যান ওই পার্ক উচ্ছেদের জন্য জেলা প্রশাসককে চিঠি দেওয়ার পরও সেটি উচ্ছেদ করতে পারেনি প্রশাসন। নদীর খাসজমি কোনো লিজ বা বন্দোবস্ত না নিয়েই সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সেখানে অবৈধভাবে পার্ক নির্মাণ করেন। নির্মাণাধীন এ পার্কে বৃক্ষরোপণ, রাস্তা উন্নয়ন কাজের জন্য ৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা ব্যয় দেখিয়েছেন সাবেক চেয়ারম্যান।

জালিয়াতদের হোতা : যুবলীগসূত্রে জানা গেছে, এনআইডি জালিয়াতি করে জমি দখল মামলার মূল আসামি আশরাফুজ্জামান সুজনকে যুবলীগের রাজনীতিতে আনার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল রবিউল ইসলামের। সুজন বিএনপি আমলে ছাত্রদল করতেন। ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। ২০১৭ সালের ১৫ মে ছাত্রদল নেতা সুজনকে আহ্বায়ক করে ২১ সদস্যের শহর যুবলীগের কমিটি অনুমোদন করে কেন্দ্রীয় যুবলীগ। সুজন নেতা হওয়ার পর রবিউল তাঁকে ফুল দিয়ে বরণ করেন। এরপর সুজনও রবিউলের হাত ধরে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। এই সুজনের বিরুদ্ধে কেন্দ্রে অভিযোগ জানিয়েছেন জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি রবিউল ইসলামও। এনআইডি জালিয়াতির মাধ্যমে এম এ ওয়াদুদ নামে এক ব্যক্তির ১৩ কোটি টাকার জমি ৭৭ লাখ টাকায় কিনে নেওয়ার টাকা জোগান দিয়েছিলেন হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী মহিবুল ইসলাম ও আমীরুল ইসলাম। এ দুজন গ্রেফতারের পর ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে রবিউলের সম্পৃক্ততা উঠে আসে। জমির মূল মালিক এম এ ওয়াদুদ বলেন, ‘জালিয়াতির বিষয়টি জানার পর আমি থানায় ১৮ জনের নামে মামলা করেছি। এখন অনেকের নাম আসছে। জবানবন্দিতে অনেকের বিষয় ও জড়িত থাকার কথা আমরা জানতে পারছি। চক্রটি বড়। এ চক্রের মধ্যে উনি (রবিউল) থাকতে পারেন। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা জড়িত না থাকলে এত বড় জালিয়াতি কেউ করতে পারে না। ’

রবিউলের বিরুদ্ধে ২৫ অভিযোগ : এনআইডি কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে অন্যের জমি আত্মসাতের ঘটনায় রবিউল ইসলামের নাম আসায় দলীয় নেতা-কর্মীরা বিব্রত হন। তাঁরা এ ঘটনার সঠিক তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। ওই পরিস্থিতিতে কুষ্টিয়া-৩ আসনের এমপি ও আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ তৎকালীন জেলা প্রশাসককে সভা আহ্বান করতে বলেন। জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সম্পত্তি জবরদখলবিষয়ক জেলা কমিটির জরুরি সভা ডাকেন। ওই সভায় জমি জালিয়াতির অভিযোগ বিষয়ে জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেনকে প্রধান করে পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাত ও সরকারি কৌঁসুলি অনুপ কুমার নন্দীকে সদস্য করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়। এরপর ওই কমিটির কাছে জমি দখলের ৫০টি অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে ৪৪টি অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়। এসবের মধ্যে রবিউলের বিরুদ্ধে ২৫টি অভিযোগ রয়েছে। তাঁর ভাই গোলাম সাবের লাল ও মফিজুল ইসলামের বিরুদ্ধেও পাঁচটি অভিযোগ জমা পড়ে। ওই কমিটির সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) অনুপ কুমার নন্দী বলেন, ‘ভূমিসম্পত্তি জবরদখলবিষয়ক জেলা কমিটির ওই জরুরি সভা সাবেক ডিসির সময় হয়েছিল। আমরা শুনানিও করেছিলাম। কিন্তু সবকিছু পেন্ডিং রেখে ডিসি সাহেব (২০২১ সালে ফেব্রুয়ারি) চলে যাওয়ার পর ওই কমিটির কোনো মিটিং হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, এ বিষয়ে এমপি মাহবুব-উল আলম হানিফ প্রশাসনকে কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন। জমি জালিয়াতির ঘটনায় যে বা যারা জড়িত তারা যত বড় ক্ষমতাধর হোক না কেন কাউকে যেন ছাড় না দেওয়া হয়। এর পরও জমি জালিয়াত রবিউলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এসব বিষয়ে জানতে কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রবিউল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এখানে কমেন্ট করুন: