মো< শফিকুল ইসলাম(মতি)নরসিংদী:আজ ১২ ডিসেম্বর, নরসিংদী হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ও আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে নরসিংদী মুক্ত হয়েছিল। এ দিনে সম্মিলিত মুক্তি বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে নরসিংদী শহরসহ গোটা জেলা পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ দিনটি নরসিংদীবাসীর কাছে গৌরবোজ্জ্বল ও স্মরণীয় দিন। প্রতি বছরই দিবসটি পালনে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে জেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে শতাধিক খণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ঐ যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মমতার শিকার হয়ে শহীদ হন ১১৬ জন বীর সন্তান। এরমধ্যে নরসিংদী সদরের ২৭, মনোহরদীর ১২, পলাশে ১১, শিবপুরের ১৩, রায়পুরায় ৩৭ ও বেলাব উপজেলার ১৬ জন।

রাজনৈতিকভাবে অগ্রসরমান ঢাকার অদূরে নরসিংদী জেলায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল এক অদম্য শক্তি নিয়ে, স্বপ্রণোদিতভাবে। যুদ্ধ অনভিজ্ঞ তরুণ ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, জনতা প্রতিশোধ স্পৃহায় অটুট মনোবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। মনোবলই যে অধিকতর শক্তিশালী পুরো যুদ্ধকালীন সময়ে তার প্রমাণ রেখেছেন নরসিংদীর বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

১৯৭১’র পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের কথা মনে করে এখনো ভয়ে আতকে উঠেন নরসিংদীবাসী। স্বজন হারানোদের কান্নায় এখনও ভারী হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতার স্বাক্ষী অনেক গণকবর রয়েছে নরসিংদী জেলাজুড়ে। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পার হলেও এখনও অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে আছে এসব গণকবর। সংরক্ষণ না করায় অরক্ষিত এসব গণকবরের শেষ চিহ্নটুকু মুছে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নরসিংদীর এমন কোনও স্থান নেই যেখানে ৭১-এ শত্রু সেনাদের নিষ্ঠুর ছোবল পড়েনি। ১৯৭১ সালে নরসিংদী জেলার বেশ কয়েকটি স্থানে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকেই নরসিংদী জেলায় প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ৭১’এ বর্তমান জেলা সদরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ২৭/২৮ জনকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প নরসিংদীর টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আটক রাখা হতো। নির্যাতন শেষে তাদের নিয়ে যাওয়া হতো বর্তমান ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাঁচদোনা মোড় সংলগ্ন লোহাপুলের নীচে। সেখানে ৪/৫ জনকে বসিয়ে রেখে তাদের সামনে ২০/২২ জনকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। হত্যা শেষে লোহারপুলের নীচে সবাইকে একসঙ্গে মাটিচাপা দেয়।

আজও স্থানীয় বাসিন্দাদের কানে সেদিনের আত্মচিৎকারের শব্দ ভেসে আসে। বোমা বর্ষণ ও নরসিংদী দখলের পর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের কারণে বিক্ষুদ্ধ অসহায় জনতা আক্রোশে ফুঁসতে থাকে। নরসিংদীর নেতারা, ই.পি.আর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সৈন্য এবং যুবক শ্রেণি দ্রুত নরসিংদী শহর ছেড়ে চলে যায়।

৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে শতাধিক খণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ৭১’এর মার্চে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে নরসিংদীতে ই.পি.আর, আনসার ও পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। এতে হাজার হাজার ছাত্র জনতা তাদের স্বাগত জানায়। নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে শত শত যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরে শুরু হয় প্রতিবাদ. প্রতিরোধ ও চোরাগুপ্তা হামলা। স্থল পথে মুক্তিবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধে টিকতে না পেরে ৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ও আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে নরসিংদী মুক্ত হয়।

মুক্তিযুদ্ধে নরসিংদী জেলা ছিল ২নং সেক্টরের অধীনে। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ। নরসিংদীকে ৩নং সেক্টরের অধীনে নেওয়া হলে কামান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মোঃ নূরুজ্জামান।

মুক্তিযুদ্ধকালীন থানা কমান্ডার মুহাম্মদ ইমাম উদ্দিন, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের দিনগুলোর কথা আলোকপাত করতে গিয়ে জানালেন, ভারতের মেলাঘর ট্রেনিং সেন্টার থেকে নরসিংদী থানার সাব ইউনিট কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও তিনি নৌ সৈনিক সিরাজের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে ১ নম্বর ইউনিটের (নরসিংদী, শিবপুর, রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজার) প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর পরিকল্পনায় ও তত্ত্বাবধানে পাঁচদোনার দ্বিতীয় বৃহৎ যুদ্ধ পরিচালিত হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নরসিংদীতে প্রথমে যুদ্ধ শুরু হয় নিয়মিত পদ্ধতিতে। পরবর্তী সময়ে গণবাহিনী গড়ে ওঠে ও মুক্তিযুদ্ধ গণযুদ্ধে পরিণত হয়। এই গণযুদ্ধে সাবেক ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআরসহ সেনাবাহিনী, আনসার, মোজাহিদ, পুলিশ বাহিনীর জওয়ানেরা ও ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক জনতা অর্থাৎ নরসিংদীর সর্বস্তরের জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়েন। চালাতে থাকেন আক্রমণের পর আক্রমণ।

মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যের পর সাফল্য ও ব্যাপক তৎপরতায় হানাদারদের মনোবল ভেঙে পড়ে। তারা সব সময় সন্ত্রস্ত অবস্থায় দিন কাটাতে থাকে। এদিকে দেখতে দেখতে মুক্তির দিনও দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে আসতে থাকে। ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে রায়পুরা ও সদর উপজেলা ছাড়া জেলার সব এলাকা সম্পূর্ণভাবে মুক্ত এলাকায় পরিণত হয়। পরে ১০ ডিসেম্বর রায়পুরা মুক্ত হওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী নরসিংদী শহরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। প্রথম থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের এত ব্যাপক তৎপরতা ছিল যে একটু সময়ের জন্যও হানাদারদের বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া হতো না।

ইমাম উদ্দিন বলেন, এমনিভাবে সাফল্য-ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে চলে আসে ১১ ডিসেম্বর। এদিন শিবপুরের মজনু মৃধার নেতৃত্বে খোদ নরসিংদী শহরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জটি উড়িয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধারা। তার পরের দিন অর্থাৎ ১২ ডিসেম্বর সকালবেলায় সংঘটিত হয় নরসিংদীর শেষ যুদ্ধ। নৌ সৈনিক সিরাজের নেতৃত্বে জিনারদী রেলস্টেশনের পূর্ব পাশে পাটুয়া গ্রামে সংঘটিত এ যুদ্ধে ২১ জন হানাদার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ফলে ১২ ডিসেম্বর নরসিংদী সম্পূর্ণভাবে মুক্ত এলাকায় পরিণত হয়।

নরসিংদী মুক্ত হওয়ার পর ১২ ডিসেম্বর বিকেলে ৪ গার্ড রেজিমেন্ট ও মিত্র বাহিনীর ‘৩১১-মাউনটেন ব্রিগেড’ নরসিংদী অঞ্চলে পৌঁছায়। ১৩ তারিখে তারা ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়। পরে ক্রমান্বয়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় বহু আকাঙ্ক্ষিত বিজয়। কিন্তু ১২ থেকে ১৬ ডিসেম্বর এরই চারটা দিন এলাকাবাসীর কাটে মুক্তির অপেক্ষা, আতঙ্কে আর উৎকণ্ঠায়। কখন না আবার হয় আক্রমণ, থেমে যায় মুক্তির আনন্দ। স্বাধীনতার দীর্ঘ নয় মাসে নরসিংদী জেলার বিভিন্ন থানায় শতাধিক যুদ্ধ, খণ্ডযুদ্ধ ও অসংখ্য অপারেশন হয়। এসব যুদ্ধ ও পাকিস্তানি বাহিনীর নিপীড়ন-নির্মমতার শিকার হয়ে মোট ১১৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

নরসিংদী সদর উপজেলার পাঁচদোনা ইউনিয়নের নেহাব এলাকার নিজ বাড়িতে বসে এসব কথা বলছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন থানা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ ইমাম উদ্দিন।

নরসিংদী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুল মোতালিব পাঠান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নরসিংদীর মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরব্বোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। সশস্ত্র যুদ্ধে জেলার বিভিন্ন স্থানে শত শত নারী পুরুষকে নির্বিচারে হত্যা করে গণকবর দিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। গণকবরগুলোর বেশিরভাগই চিহ্নিত করা হয়েছে। বর্তমান সরকার এসব সংরক্ষণ করার চেষ্টা করছে।’

নরসিংদীর জেলা প্রশাসক সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে নরসিংদীর বধ্যভূমিগুলো অযত্ন ও অবহেলায় থাকবে না। বর্তমান সরকার এসব সংরক্ষণে খুবই আন্তরিক। এরমধ্যে বেশকিছু সংরক্ষণের বরাদ্দ হয়েছে, বাকিগুলো মন্ত্রণালয়ে অপেক্ষমান আছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন হবে। ’

এখানে কমেন্ট করুন: